মূল গল্পঃ Death of a Clerk by Anton Chekhov
অনুবাদঃ ঈশান কর্মকার
কেরানির মৃত্যু
এক মনোরম সন্ধে, হলের দ্বিতীয় সারিতে বসে আছেন
পেশায় সরকারি কর্মচারী ইভান দিমিত্রিচ চারভিয়াকভ, অপেরা গ্লাসে নিবদ্ধ চোখে উপভোগ
করছেন লে ক্লোসে দে করনেভিল। মঞ্চের
দিকে তাকিয়ে তার মনে হচ্ছিলো তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি, ঠিক এমন সময় হঠাৎ
... এই “হঠাৎ” কথাটি বড্ড পুরনো হয়ে গ্যাছে,
গল্পে আজকাল আর চলে না। কিন্তু লেখকদের উপায় নেই, জীবনে বিষ্ময়ের কি অন্ত আছে? তাই
হঠাৎ তার মুখ গেল কুঁচকে, বুজে এলো চোখ, শ্বাসরোধকর অবস্থা ... তিনি চোখ থেকে
ওপেরা গ্লাসটি সরিয়ে নিলেন, ঈষৎ সামনে ঝুঁকলেন এবং ... “হ্যাচ্চো”, অর্থাৎ সশব্দ
এক হাঁচি। এহেন হাঁচি কোনও অপরাধের বিষয় নয়। চাষীরা হাঁচে, পুলিশ হাঁচে, এমনকি
প্রিভি কাউনসিলাররাও হাঁচে। সব মানুষই হাঁচে। চারভিয়াকভ সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র
লজ্জিত বা বিড়ম্বিত নন, তিনি রুমালে নাক
মুছলেন এবং ভদ্রলোকের মতো চারদিক একবার দেখে নিলেন তার হাঁচিতে কেউ বিরক্ত হয়েছে
কিনা। কিন্তু পরমুহূর্তেই তিনি পড়লেন এক মহা বিড়ম্বনায়। দেখলেন তার সামনে প্রথম
সারিতে বসা এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক সযত্নে তার টাক ও ঘাড় মুছে নিচ্ছেন ও বিড়বিড় করে কী
যেন বলছেন। চারভিয়াকভ চিনতে পারলেন ভদ্রলোককে, নাম দ্রিজালভ, পরিবহন দপ্তরের
সিভিলিয়ান জেনারেল।
“সর্বনাশ, একেবারে ভদ্রলোকের গায়েই হেঁচে দিয়েছি,”
ভাবলেন চারভিয়াকভ, “তিনি আমার দপ্তরের প্রধান নন তবুও ব্যাপারটা খারাপ । আমাকে
ক্ষমা চাইতে হবে।”
চারভিয়াকভ একটু গলা খাকরে নিয়ে সম্পূর্ণ ঝুঁকে
পড়লেন এবং ভদ্রলোকের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “মহাশয় আমাকে ক্ষমা করবেন,
অনিচ্ছাকৃতভাবে আপনার গায়ে হেঁচে দিয়েছি ...”
“ঠিক আছে, ঠিক আছে”
“আমায় মার্জনা করে দিন, আমি ... মানে ইচ্ছেকরে করিনি”
“আঃ বললাম তো ঠিক আছে। এবার দয়া করে বসুন, শুনতে দিন”
বিড়ম্বিত চারভিয়াকভ বোকার মতো একগাল হাসলেন ও মঞ্চের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন। কিন্তু
তিনি তাকিয়েই রইলেন, পূর্বের আনন্দ আর হচ্ছিল না। বরং বেশ অনুতাপ হচ্ছিলো তার। তাই বিরতির সময় তিনি সোজা গেলেন ব্রিজালভের কাছে, তার চারপাশে কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করলেন এবং
অবশেষে সংকোচ কাটিয়ে বললেন, “মহাশয়, বলছি, আপনার গায়ে আমি হেঁচে দিয়েছিলাম ... আমাকে
মার্জনা করবেন ... বুঝতেই পারছেন ... আমি ইচ্ছেকরে করিনি ...”
“ও তাই নাকি ... আমার তো কিছুই মনে নেই, আপনি ব্যাপারটা নিয়ে এখনও ভাবছেন?”, বললেন জেনারেল।
“যতই বলুক কিছু মনে নেই, চোখমুখ দেখে মোটেও ভাল লাগছে না,” সন্ধিগ্ধ চোখে
জেনারেলকে একবার দেখে নিয়ে ভাবলেন চারভিয়াকভ, “তাছাড়া কথাও বলতে চাইছেন না। নাঃ আমাকে
সব খুলে বলতে হবে ... যে আমি ইচ্ছাবশত করিনি ... এটাই একমাত্র উপায়, নয়তো তিনি
ভাববেন আমি ইচ্ছে করে হেঁচে দিয়েছি । এখন হয়তো নয়, পড়ে এমনটাই ভাববেন।”
বাড়ি পৌঁছে সব ঘটনা স্ত্রীকে জানান চারভিয়াকভ। তার মনে হল তার স্ত্রী গোটা
ঘটনাটা হাল্কাভাবে নিয়েছেন । প্রথমে একটু চিন্তিত ছিলেন ঠিকই, কিন্তু ব্রিজালভ
অন্য দপ্তরে কর্মরত এটা শুনে তার স্ত্রী আশ্বস্ত হন।
“ তবুও তোমার উচিৎ একবার গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া, ” স্ত্রী বললেন, “নয়তো তিনি ভাবতে
পারেন তোমার সৌজন্য বোধ নেই।”
“আরে সেটাই তো! আমি ক্ষমা চেয়েছি, কিন্তু কি অদ্ভুত। তিনি এ ব্যাপারে একটা
কথাও বললেননা । তাছাড়া কথা বলার আর সময় ছিল না।”
পরদিন চারভিয়াকভ নতুন ইউনিফর্ম পড়ে, চুল দাড়ি কাটিয়ে ব্রিজালভের কাছে ছুটলেন; জেনারেল সাহেবের কক্ষে ঢুকে দেখলেন অনেক পিটিসনার উপস্থিত ও
তাদের মাঝে উপবিষ্ট স্বয়ং জেনারেল পিটিসন জমা নিচ্ছেন। বেশ কিছু
পিটিসনারকে জিজ্ঞাসাবাদের পর তিনি চোখ তুলে সামনে দেখতে পেলেন চারভিয়াকভকে।
“মহাশয় গতকাল রাতে, আর্কেডিয়ায়, আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই,” শুরু করলেন
চারভিয়াকভ, “ আমি – মানে হেঁচে দিয়েছিলাম।”
“ধুর! কী যাতা বলছেন!,” বলে জেনারেল
পরবর্তী পিটিসনারকে ডাকলেন।
“শুনতেই চাইছেন না আমার কথা!,” এটা ভেবে চারভিয়াকভের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
“তার মানে উনি রেগে আছেন ... নাঃ ব্যাপারটা এভাবে ছাড়া যাবে না ... আমাকে সব খুলে
বলতেই হবে।”
শেষ পিটিসনটি জমা নিয়ে জেনারেল সাহেব তার ব্যাক্তিগত কক্ষের দিকে পা বাড়িয়েছেন
ঠিক সেই সময় চারভিয়াকভ তার পেছন পেছন গিয়ে বললেন, “মহাশয়, শুনছেন! নিতান্ত
অনুশোচনায় তাড়িত হয়েই আপনাকে একটু বিরক্ত করছি ...”
“আপনি কি মস্করা করছেন মশাই আমার সাথে ?!,” বলে তিনি মুখের উপর দরাম করে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
“মস্করা কোথায় করলাম ?”, ভাবলেন চারভিয়াকভ, “কোনো প্রশ্নই ওঠে না মস্করার।
তিনি জেনারেল, তার বোঝা উচিৎ। আচ্ছা বেশ, যদি মস্করাই মনে করে থাকেন তবে ঐ ভদ্রলোকের
কাছে আমি আর ক্ষমা চাইবো না। জাহান্নামে যাক । আমি বরং একটা চিঠি লিখে দেবো,
কিন্তু সশরীরে যাবো না, আর না।”
এইসব ভাবনাচিন্তা করে চারভিয়াকভ বাড়ি
পৌছোলেন। তিনি ভাবতেই থাকলেন, ভাবতেই থাকলেন, কিন্তু চিঠির বয়ান কিছুতেই তার মাথায়
এলো না, জেনারেলকে একটি চিঠিও লিখতে পাড়লেন না। অগত্যা পরদিন আবার হাজির হলেন,
সশরীরে।
“মহাশয় গতকাল আপনাকে বিরক্ত করেছিলাম,
” বিড়বিড় করে বললেন চারভিয়াকভ, “তা নিছক মস্করা করার জন্য নয় আপনি যেমনটা
ভেবেছিলেন। আমি আসলে শুধু ক্ষমা চাইতে এসেছিলাম আপনার গায়ে হেঁচে দেওয়ার জন্য ...
আমি মস্করা করার কথা কখনই ভাবিনি। আমার কি সে সাহস আছে, আমরা যদি মস্করাই করি তাহলে
শ্রদ্ধার জায়গাটা আর ঠাকে না, উচ্চপদস্ত ব্যাক্তির ক্ষেত্রে তো নয়ই ...”
“বেরোন!” গর্জে উঠলেন জেনারেল, তার মুখ লাল ও কম্পমান।
“হ্যাঁ ?” ভয়ে প্রায় বাকরুদ্ধ চারভিয়াকভ ফিসফিসয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
“বেরিয়ে যান!” মাটিতে পদাঘাত করে আবার চিৎকার করে উঠলেন জেনারেল।
চারভিয়াকভের পেট গুড়গুড় করতে লাগলো । আর কোনোদিকে দৃষ্টিপাত ও কর্ণপাত না করে
তিনি দরজা পেড়িয়ে সোজা রাস্তায় গিয়ে ঊঠলেন, এবং হাঁটা লাগালেন। কোনোক্রমে বাড়ি
পৌঁছে, ইউনিফর্ম না খুলেই তিনি সোফায় শুয়ে পড়লেন এবং মারা গেলেন।
No comments:
Post a Comment