প্রথম বর্ষ ✦ দ্বিতীয় সংখ্যা
বুকঝিম এক ভালবাসার 'হিট' মশলা সন্ধানে
সৌপ্তিক
উপন্যাস: সৈয়দ শামসুলহক
নির্দেশনা ও
অভিনয়: শ্রমণ চট্টোপাধ্যায়
সঙ্গীত
পরিচালনা: শুভদীপ গুহ
তালবাদ্য ও
কন্ঠসঙ্গীত: চক্রপাণি দেব
বাশি: সুশ্রুত
গোস্বামী
তারবাদ্য: জয়ন্ত
সাহা
দোহক: সর্বজিৎ
ঘোষ, সুহানিশি চক্রবর্তী
আলো: চন্দন দাস
রূপসজ্জা: অলোক
দেবনাথ
মঞ্চ: অর্ণব ঘোষ
মঞ্চ সরবরাহ:
অজিত রায়
প্রযোজনা: অনীক
মঞ্চের উপরের বারগুলি থেকে পর পর ঝুলছে কিছু রঙিন কাগজ।
তার তলায় মঞ্চের উপর বসে আছে একদল গান। তার সামনে ধুতি আর ফতুয়া পরে একটি যুবক
লাঠি আর গামছা নিয়ে একের পর এক উচ্চারণ করছে বিশ-একুশ শতকের নাগরিক মানুষের লিখে
যাওয়া কথা- একটি উপন্যাস। 'বুকঝিম এক ভালবাসা'। চিরকেলে প্রেমের বিচ্ছেদ বেদনায়
ভারাক্রান্ত হৃদয়ের আধুনিক সে গাথায় পল্লীগ্রামের সরল সুর থাকতে পারে। কিন্তু
বুকঝিম 'লোক (folk)' এর সম্পত্তি নয়। কারণ বুকঝিম করা এই
গানের মূল যে সম্পদ- সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস তা কোনোভাবে
Folk
element নয়, কারণ উপন্যাস প্রকরণটিই 'আধুনিক' পাশ্চাত্য নাগরিকতার
দান। এইবার নাট্য হিসাবে বুকঝিমকে জরিপ করলে যে ব্যাপারটা সর্বপ্রথম চোখে পড়বে তাও
হচ্ছে নাগরিক কিছু মানুষের স্পষ্ট উপস্থিতি। অভিনেতা শ্রমণ চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর
সাঙ্গপাঙ্গ-রা মঞ্চে ওঠার আগে মোবাইল ব্যবহার করেন। উবের-ওলা ধরে বাড়ি ফেরেন।
এসিতেও ঘুমান হয়তো এদের কেউ কেউ। তবে ধরে নিতে হয় মানুষগুলি আদ্যন্ত না হলেও
খানিক কিংবা অনেকটাই নাগরিক। এইটুকুনি হিসেব করলেই বুঝে নেওয়া যায় যে বুকঝিম এক
ভালবাসা কিছু নাগরিক মানুষের সন্তান যা পল্লিগ্রামের কোনো এককালের ভালবাসার কথা
বলে। এইবার, মজার ব্যাপারটা হল, শুধু বুকঝিম এক ভালবাসা কেন যেকোনো হালফিলের নাট্য
যার আধারে কোনো গ্রামীণ জীবন রয়েছে, তাদের সবকটির মূলগত জায়গাই আসলে এক।
এই ওভারপপুলারিটির অঙ্ক কষতে গেলে দেখা যাবে- বুকঝিম এক ভালবাসা হেব্বি পপুলার।
বহুলোক হাউসফুল বা প্রায় হাউসফুল শো দিয়ে যাচ্ছে একের পর এক। তাও আবার এমন একটা
নাট্যকে যা কিনা দাঁড়িয়ে আছে একক একটি মানুষের অভিনয়ের উপর। মেঘনাদবধ কাব্যের
প্রসঙ্গ এসে পড়া স্বাভাবিক এক্ষেত্রে। তবে কি বাংলা নাট্যজগৎ একটা ব্র্যান্ডো বা
আলপাসিনোর জন্ম দিল বা মায় শাহরুখ খানের! যাকে দেখতে সবাই হুড়মুড়িয়ে হলে ঢুকছেন আর
রুমালে চোখ মুছতেমুছতে বলছেন, "আহা, কী দেখিলাম! জন্মজন্মান্তরেও..."
ইত্যাদি প্রভৃতি।
দশবার বুকঝিম
এক ভালবাসা, ভালোবেসে গোগ্রাসে গেলার পর ব্যাপারটা কিছুটা ঠাহর করতে পেরেছি হয়ত।
বুকঝিম এক ভালবাসা তিনটে 'না' -এর সূত্রে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে।
হাড়হিম করে দিচ্ছে বহু হিতাকাঙ্ক্ষী পরিচালকের।
১. বুকঝিমের
কোন নাট্যরূপ নেই। নাট্যরূপ দিলে বহু ভালো উপন্যাসের কী ভয়ঙ্কর পরিণতি হয় বা হতে
পারে তার উদাহরণ বহুল। সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বলি নাটকের বহুস্বরকে বাদ দিয়ে
উপন্যাসের এককস্বরকে অক্ষুণ্ণ থাকতে দেওয়া এই নাট্যের প্রথম জরুরিমশলা।
২. সেট
লাইটের না-উপস্থিতি। হালফিলের বাংলা নাট্য যে পরিমাণে আলো-মঞ্চ উপকরণের ভোজবাজিতে
অভ্যস্ত তার বাইরে গিয়ে বুকঝিম এক ভালবাসা আরাম দেয় চোখকে আর মনকে।
৩.
শ্রমণের না-অভিনয়। অভিনয়ের বোদ্ধা আমি নই। তবে এইটুকু বলতে পারি, শ্রমণ মঞ্চে
চেঁচান না, ভল্ট দেন না, অ্যাকশন সিকোয়েন্সে চমৎকারি লাঠিখেলা দেখান না, এমনকি গলাও
কাঁপান না। খুব অল্প কিছু বাচিক এবং শারীরিক পরিবর্তনের সাহায্যে গোটা উপন্যাসটা
মঞ্চে মুখস্থ বলেন। যেটা বাংলা নাট্যের সমসাময়িক সময়ে হাতে গোনা কিছু অভিনেতা
করেন।
বুকঝিম এক ভালবাসা প্রায় দু'বছর ধরে বাংলা থিয়েটার জগতে
স্মিতহাস্যে বর্তমান। সে হাসি অতিরঞ্জিত সিরিয়ালধর্মীতার নাগরিক ক্লান্তিকে মোছে।
আমরাও সোহাগে-বিরহে জারিত হয়ে রুমাল ভেজাই। নাগরিক ফেসবুকের দেওয়ালে স্ট্যাটাস দিই
চিরন্তন বেদনার বাহক সেই সব পঙক্তি গুচ্ছ যারা আদতেই চিরকালীন। আর সবচেয়ে বড় কথা সবুজ ফিরে পাই হৃদয়ের গহনে।
* * * * *
No comments:
Post a Comment