‘ক্ষুধা লিখো। অন্ন লিখো। নইলে
তুমি খুনি।’
‘অভিশাপ দাও, নয়তো তোমাত হস্ত
লোহিতবর্ণ ধারণ করিবে।’
কী
অমোঘ এই পঙক্তি! কী নির্বিকল্প এই অনুভব! যেন মহাকাল এসে বলে যাচ্ছে খণ্ডিত কালের
কানে কানে,- এই ঝঞ্ঝা সত্যি। এই মহামারী সত্য। এই বাকরোধ, শ্বাসরোধ সত্যি। তবু
লেখো ক্ষুধা। যতক্ষণ তুমি ক্ষুধা লিখতে পারছ, ততক্ষণই তুমি বন্দনা করছ অনন্ত
জীবনকে। যতদিন তুমি লিখতে পারছ অন্ন, ততদিনই তুমি খুনি নও। যতবার তুমি
অভিশাপ দিতে সক্ষম, ততবারই আসলে তুমি গড়ে তুলতে পারো প্রতিরোধ। সাদিক হোসেনের
সাম্প্রতিক গল্পগ্রন্থ ‘হারুর মহাভারত’ বলে চলে এই জীবনের কথা। জীবনকে
বন্দনাসূত্রে আবশ্যিক প্রতিরোধের কথাও।
এই যে
বহু অধ্যায়ে বিধৃত মহাভারত, তা আমাদের কী বলে? কেবলই রাজাদের গল্প, যুদ্ধ, লিপ্সা,
ক্ষমতা আর তার রাজনীতির কথা? তা বলে বটে। সে তো ইতিহাসও বলে। আর, শুধু এইসব বলে
বটেই রবীন্দ্রনাথ খেদ করে বলেছিলেন, এ-ইতিহাস ‘নিশীথকালের এক দুঃস্বপ্ন কাহিনী
মাত্র’। কে কোথা থেকে এল, মারামারি-কাটাকাটি হল, তাতেই ইতিহাস ঠাসা। সে-সব নাহয়
হয়েওছিল। নাহয় কেন, নিশ্চিতই হয়েছিল। কিন্তু এই ইতিহাসে ভারতবাসী কোথায়!
রবীন্দ্রনাথ বলেন, ঝড়ের দিনে ঝড়ই যে প্রধান ঘটনা তা-নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই
প্রবল ঝঞ্ঝার মধ্যেও যে জীবন-মৃত্যু-সুখ-দুখের প্রবাহ চলে, তা ঢাকা পড়ে গেলেও,
মানুষের কাছে সেটাই প্রধান। মহাকালের কাছেও প্রধান তো এই জীবনস্রোত-ই। মহাকাব্যের
কাছেও। ফলে, যে-কোনো ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সময়ে এই অনন্ত প্রবাহের চেতনাটিকে আবিষ্কার
করে নাড়ি ছুঁয়ে থাকাই কর্তব্য। সাদিকের কলম তার অন্যথা হয়নি। তিনি ছুঁয়ে থেকেছেন
সেই মহাকাব্যিক জীবনপ্রবাহকে, যা সামান্য সামান্য নিয়েই অসামান্য। আর অসামান্য
বলেই তা বৃহৎ ও অমিত ক্ষমতাশালী। সেই অনন্ত জীবনের ক্ষমতার কাছে যে-কোনো মদগর্বী
ক্ষমতার তল্পিবাহক নিঃস্ব হয়ে যেতে পারে মুহূর্তে।
এই
জীবনের প্রসঙ্গেই আমাদের মনে পড়ে যাবে মার্কেজকে। নোবেল ভাষণে লাতিন আমেরিকার
নিয়তি বর্ণনা করতে করতে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ক্ষমতা ও দম্ভের কথা বলতে বলতে উপসংহারে
পৌঁছে, আরাধ্য ফকনারকে স্মরণ করে মার্কেজ বলবেন, ‘never the less, in the force of oppression,
pillage and abandonment, our reply is life.’ ফকনারও বলেছিলেন, মানুষের ক্ষয়
নেই। একধাপ এগিয়ে মার্কেজ জানিয়েই দিলেন, শত ঝঞ্ঝা, শত দমন, শত মহামারী পেরিয়েও
জীবন-ই উত্তর। জীবন সংক্রান্ত যা-কিছু প্রশ্নের উত্তর স্বয়ং জীবন। ঠিক এখান থেকেই
শুরু হয় ‘হারুর মহাভারত’। আমরা খেয়াল করলে দেখব, এই যে গল্প হিসেবে কয়েকটা করে
পাতা আমরা উলটে চলেছি, আসলে তাতেই বিধৃত রয়েছে সেই অনন্ত জীবন। কুশলী লেখক,
সেগুলোর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন অনন্ত মায়া আর অবিচ্ছিন্ন চেতনা। ফলে বই শেষ হলে সেই
জীবনের সামনে নতজানু হয় পাঠক।
কেমন
সে জীবন? যেমন হয়, অপমানিতের, নিপীড়িতের, শোষিতের জীবন। আসুন চোখ রাখি –
‘ ... চারিদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে – শ্রমদাসত্ব উচ্ছেদ করে
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া শ্রমিকশ্রেণি এবং নিপীড়িত জনতার সামনে
অন্য পথ খোলা নেই।
সত্যিই কি কোনও পথ খোলা নেই?
ছলিমুল্লার ২ বছরের ছেলেটা মাসখানেকের সর্দিকাশিতে
হোমিওপ্যাথি খেতে খেতে মরে গেল। ২ দিন কারখানায় গেল না ছল্লিমুল্লা। ছোলা পড়ানির
পর মজদুর ইয়নিয়নের নেতা রতনলাল তার পিঠে হাত রেখে বলল, আমরা হলাম শ্রমিকশ্রেণি।
বাস্তববাদী সত্যকে তো মেনে নিতেই হবে আমাদের, তাই না?
কিন্তু সত্য কাকে বলে?
রাতেরবেলা বউ-এর দিকে তাকিয়ে থাকে ছলিমুল্লা। মাইয়ের বোঁটা
থেকে দুধ গড়িয়ে ব্লাউজ ভিজিয়ে দিয়েছে। সে চটচটে ব্লাউজের উপর মুখ ঘষে। ভোরের দিকে
বউ উঠে পেচ্ছাব করতে গেলে সে কী অশ্লীল শব্দ শোনে। ছরছর করে সত্য যেন ধুয়ে চলে
যাচ্ছে বাথরুমের নল দিয়ে।’
(ইয়ান আব্রাহামের একান্ত সুসমাচার)
এই সেই
জীবন, এই সেই সত্য, যা আমাদের হতচকিত করে তোলে। প্রশ্ন জাগে, এরপরেও এ-জীবন, এই
হতশ্বাসের জীবন টিকে থাকে করে? অন্যত্র এর জবাব দেন লেখক, বলেন, মায়া ছাড়া
নিম্নবিত্তের সংসার বাঁধা থাকবেই কী করে? আসলে মায়াই চালিয়ে রাখে এই জীবনের
স্রোতকে। এই মায়াই ছলিমুল্লার বউ-এর সঙ্গে মিলিয়ে দেয় রাজিয়াকে। বিয়ের রাতে যে
দেখল,
জুলু একখানা খেলনার পিস্তল লইয়া তাহার বুকের উপর বসিয়া
রহিয়াছে।
রাজিয়ে সর্বশক্তি দিয়াও কিছুতেই অকর্মণ্যটিকে ফেলিতে পারিল
না।
পরেরদিন স্নান সারিয়া তবে বাহিরে আসিল রাজিয়া। তাহার কক্ষ
হইতে তখনও খেলনার বন্দুকের আওয়াজ আসিতেছিল।
জুলুর মা আর নববধূটিকে কিছু জিজ্ঞাসা করিল না।
রাজিয়া সিঁড়ি দিয়া নিচে নামিতেছে। তাহাকে ঘিরিয়া রহিয়াছে
মহাজনের মহল। বহুকিছুর বিনিময়ে আজ সে পণ্যের অধিকার পাইয়াছে। এই অধিকার সে কিছুতেই
ফিরত দিবে না।
(তিনমহলা)
অধিকার,যদিও
পণ্যের। তবু অধিকার। তাও সে ফেরত দেবে না। আসলে এভাবেই বহুকিছুর বিনিময়ে জীবন কখন
একটু জেতে, তো একটু হারে। এই যে হায়দার আলি স্ত্রীর অসুখ কামনা করেই বসেছিল,-
‘এতদিনে হায়দার জেনে গেছে কিছু সমস্যার সমাধান হয় না। তখন ঝুলে থাকাটাই শ্রেয়।
ঝুলে থাকাটাই বুদ্ধির পরিচয়। জিভ আর সরবিট্রেটের মধ্যবর্তী ঘনত্বের মতোই সে বাকি
জীবন ঝুলে ঝুলে থাকতে চায়।’ এই তো জীবন, যা আমাদের বিস্মিত করে। স্তব্ধবাক করে।
তবু নির্জলা, নিখাদ জীবন।এবং এতকিছু সত্ত্বেও তার এগোনো থামে না। ‘মারাদোনার বাম
পা’ গল্পে, তাই সমর্থ বন্ধু প্রদীপ্তর ছেলের পা থেকে বলটা কেড়ে নিয়ে মিলনের মেয়ে
যখন এগোতে থাকে, লেখকের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও জানি, ‘এখন তাকে রুখবে এমন বান্দা
দুনিয়াতে জন্মায়নি।’
সত্যি
তো, এই জীবনকে কে রুখবে! কে আটকাবে এই মহাভারতের নির্মাণ! সাম্রাজ্যবাদী শক্তির
স্তম্ভ গড়ে ওঠে, ধ্বসেও যায়। থেকে যায় এই অবিচল জীবন। আর থেকে যায় সেই জীবনকে লিখে
যাওয়ার উত্তরাধিকার। ফকনার জানতেন, মার্কেজ জানতেন, সাদিকও জানেন, বস্তুত অক্ষয় কলম
মাত্রই জানে, জীবনের অবিনশ্বর সত্যিটুকু – মানুষের ক্ষয় নেই।
Previous Issues (Book Review) :
No comments:
Post a Comment