দ্বিতীয় বর্ষ ✦ প্রথম সংখ্যা
কালী নদীর জল
মাসুম মাহমুদ
মাঝখানের দেয়াল দুই পাশের মানুষকে শারীরিকভাবে আলাদা করে রাখলেও প্রবল জীবনীশক্তি ঠিক নিভৃতে কথা বলিয়ে যায়। নইলে কী করে অনেকটা সময় নিশ্চুপ থাকার পর বাইরে দরজার সামনে কিংবা উদোম উঠোনে একে অন্যের দিকে থাকিয়েও ভেতরটা বুঝে উঠে! এই বুঝে যাওয়ার সীমাবদ্ধতা আত্রীয়তার গন্ডি পেরিয়ে বহুকাল ধরে বহু মানুষের মধ্যে বিরাজমান ।
যে-তিনটে জাগ্রত মানুষ নিশি রাতে ঝি ঝি পোকা বা দূরথেকে আসা শিয়ালের ডাক বহন করা আধভাঙ্গা ঘরটির দুই রুমে অবস্থান করছে, তাদের সম্পর্কটা রক্তের । একজন ছিপছিপে হালকা পাতলা, মায়াময় চোখ আর সরু গোফওয়ালা ১৮-১৯ বছরের যুবক সেলিম । অন্য দুজন তার বাবা-মা । বিছানায়, পুবের জানালা কিংবা বসত ঘরটির কোণায় ভাসমান রান্না ঘরটিতে অবস্থানরত এই তিনজন মানুষের ভাবনায় ভিন্নতা থাকলেও কোথায় যেনো একটা আশ্চর্য রকমের মিল । যেনো ওদের প্রত্যেকেরই একে অন্যের ভেতরটা বুঝে ওঠার পাখা আপনাতে দুলে ওড়ে বেড়াচ্ছে।
এইতো দুপুরে, উঠোনের শেষটায় আঙ্গুলকে অস্ত্র বানিয়ে ফাকা মাটিতে গুলি চালিয়ে আঁড় চোখে বাবার দিকে থাকিয়ে সেলিম মনে মনে ভাবছিল,জানি সব ঠিক হয়ে যাবে। ছেলে কিছু করবে। সংসারের অভাব মিটবে ।
তিনবেলা খাওয়ার বাসনে মাঝে মধ্যে আরো ভালো, আরো সু-স্বাদু খাবারও আসবে । ঘরের বেড়াগুলো বাশের পরিবর্তে ইটে রুপান্তরিত হবে। আর সেই সাথে শৈশবের হাসি নিয়ে আমার মধ্য বয়সটা আনন্দে ভরে উঠবে,'তারপর বিড়বিড় করে বলে,“এইতো ভাবছিলে বাবা?
অন্যদিকে সেলিমের মা হাসগুলো খোয়ারে পাঠিয়ে ছেলের পাশে এসে বসে,খানিক আগে মাটিতে আঁকা মানুষের ছবির উপর একটা ক্রস চিহ্ন এঁকে আলতো টেনে ধরে ছেলের হাত, শিউরে উঠে সেলিমের শরীর । মায়ের এই একটুখানি স্্পশ তার শরীরে বয়ে বেড়ানো টগবগে রক্ত যেনো শীতল হয়ে যায়। তার রক্ত চক্ষু দুটোতে নেমে আসে সম্পর্কের জল। মায়ের মাথা ভর্তি চুলের ভিতর বেড়ে ওঠা দু তিনটে পাকা চুলে হাত বুলায় সেলিম। রক্ত টানে ঠিক টের পায় কি ঘুরছে মাথাটার ভেতর,“জানি, কি তোর ইচ্ছে? চারিদিকের এই অশান্ত পরিবেশ, এই দাঙ্গা, খুনোখুনি আর ধ্বংস সইতে পারছিস না সেও জানি। তোরাই যখন এই প্রতিহিংসা আর ধ্বংসের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিস, লড়ছিস? তখন তুই আর চুপ করে ঘরে বসেথাকতে পারছিস না সে-কি আমি মা বুঝি না? যা বাবা!বাঁপিয়ে পড়। যুদ্ধে গেলে মরে যাবি সে ভয় আমার নেই। কিন্তু এই যে ঘরে বসে প্রতিনিয়ত মরে যাচ্ছিস এই যন্ত্রনা আমি সইতে পরছি না।"
এইভাবেই বাবা-মায়ের মনের কথাগুলো সে মনে মনে আওড়ায়। তারপর সন্ধ্যেবেলা রাতের খাবার নিয়ে তিনজন ওরা ঘরের মেঝেতে বসে পড়ে । অভাবের সংসারে আজ হঠাৎ করেই ঘরে আসা বড় রুই মাছের মাথাটা সেলিমের পাতে বেড়ে দেয় মা। বুকের ভেতরটায় চিন করে উঠে তার, কতোবারইতো এমনি করে পাতে তুলে দিয়েছে মা। কিন্ত কখনো এমন চিন করে উঠেনি! অদৃশ্য সুন্দর সন্ধ্যায় মা-ছেলে নিশ্চুপ কথা বলে যাচ্ছে নিজেদের সাথে । এরা বুঝে গেছে একই আয়োজনে কেন আজ ভিন্ন অনুভূতি ।
বড় বড় চোখে নিজের পাতের উপর তাকায় সেলিম। মুঠো ভরে তুলে নেয় রুই মাছের মুদ্ডুটা। চোট হয়ে আসা চোখে একগাল হাসে। ও হাসিতে কোথা হতে যেন মায়ের বুকের ভেতর খানিক প্রশান্তি নেমে আসে। কতোদিন পর ছেলেকে এমনি করে হাসতে দেখছে। সেলিম বাবার দিকে তাকায় । তার ব্যস্ত হাত বাবার বাসন ঘুরে এসে শান্ত হয়। ভেতরে ভেতরে অশান্ত বাবা একটি কথাও বলছে না।ছেলের অসীম ভালোবাসার গভীর অনুভূতি তার সমস্ত শরীরে ছুটে বেড়াচ্ছে । আজ যেনো ভালোবাসাটা একটু ভিন্ন।
জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
এক একটা গৃহস্থ টিকটিকিকে দেখেও কত কিছু মনে পড়ে। ঠান্ডা কমলেই তারা আবার উঁকি দিতে শুরু করে। কেউ জলের পাইপ, কেউ দরজার পাল্লার পেছন থেকে বেরিয়ে আসে। খুব কাছাকাছি এসে পড়লে চমকে উঠে আবার আড়াল খোঁজে, দূরত্ব বাড়াতে চায়। রাষ্ট্রের সেই সব নাগরিকদের মত, যারা তিন পুরুষ এক দেশে থাকলেও হঠাৎ করেই আর দেশের কেউ থাকে না। কোনো দেশই তাদের না। তারাও ক্রমে কোনো দেশের থাকে না। তারা রাত হলে বেরিয়ে আসে, আর চোখে-মুখে আলো পড়লে শিউরে উঠে আড়াল খোঁজে। প্রমাণ করার কিছু নেই বলেই, আরো ইচ্ছে করে তাদের তাদের কাছে প্রমাণ চাওয়া হবে। সফট অ্যান্ড ইজি টার্গেট। অথচ এই ভাবে নজর বাঁচিয়ে তারা এক একটা রাত পার করে দেবে, দিতে শিখে গেছে। এরই মাঝে তাদের সঙ্গে নতুন মানুষের পরিচয় হয়, সংসার হয়, নতুন প্রজন্ম আসে।
বাথরুমে দাঁড়িয়ে
হঠাৎ টিকটিকিটার
সঙ্গে চোখাচুখি
হয়ে যেতে
এই কথাগুলো
মনে হল। যতক্ষণ
দাঁড়িয়ে থাকার
কথা, তার
থেকে একটু
বেশিই সময়ে
চলে গেল। কেমন
ভীতু চোখ। হঠাৎ
বিব্রত বোধ
করা মানুষের
মত, ইতস্ততঃ
করে সিস্টার্নের
পেছনে চলে
গেল।
যেন দুজনেই
একে অপরের
প্রাইভেসি নষ্ট
করছি।
এক রকম
অলশ উদ্দেশ্যহীন
কৌতূহল থেকে
তাকিয়ে রইলাম
সে দিকে। নিজেকে
আড়ালে নিয়ে
গেছে ভাবছে,
অথচ দুটো
পা, ল্যাজ
দেখা যাচ্ছে। হালকা
বাদামী রঙ,
কিছুকাল আগে
খসে যাওয়া
ল্যাজটা নতুন
করে গজাচ্ছে। আহত
প্রাণীর মনে
এমন ভয়
থাকে।
অথচ দাঁত
নেই, নখ
নেই…
পালটা আক্রমণ
করতে সক্ষম
নয় এরা। আত্মরক্ষা
করতেও সক্ষম
নয়।
অজ্ঞাতে অবহেলায়
পিষে যায়!
নখ-দন্তহীন
প্রাণীরা আগে
পালিত হয়, ভক্ষ্য হয়। কী
একটা হয়
গেল, কয়েক
মুহূর্তর জন্য
মনে হল
টিকটিকিটা লাফিয়ে
মুখের ভেতর
ঢুকে গেছে। ওই
অর্ধেক গজিয়ে
ওঠা ল্যাজটা
ঝুলছে ঠোঁটের
বাইরে।
মাথাটা দুলে
উঠল।
বাথরুমের দেওয়াল
ধরে নিজেকে
সামলানোর চেষ্টা
করলাম।
মাথাটা একটু
স্বাভাবিক হতে
একটা দীর্ঘশ্বাস
নিজে থেকেই
বেরিয়ে এলো,
পাজামার দড়িটা
বেঁধে আমিও
বেরিয়ে এলাম
বাইরে।
সিস্টার্নের জল
পরার শব্দে
ধরফর করে
আরো পেছনে
চলে গেল
টিকটিকিটা, চোখের
আড়ালে।
টিকটিকি পরজীবী
হতে পারে
কী? কখনো
কোনো বেওয়ারিশ
লাশের মুখ
থেকে কি
টিকটিকি বেরিয়ে
আসতে দেখেছি?
সিনেমায় বা
ধারাবাহিকে? কিংবা
স্বপ্নে?
‘তবে তোদের
জন্য কিন্তু
রাজ্য অনেক
কিছু করছে’-- ক্লাব বা
সেলুনের কেউ
না,
নির্বাচনের এক
মাস আগে
পুরনো পাড়ার
এক প্রতিবেশীর
থেকে কথাগুলো
শুনেছিলাম।
তিনি প্রায়
বাবার সমবয়সী। ভূগোল
পড়াতেন আমাদের
স্কুলে।
সেদিনই শুনলাম
স্যারের মুখ
থেকে, অবসর
নিয়েছেন।
ঘরে ফিরে
মা-কে
জানালাম ‘অসিত
স্যারের সঙ্গে
দেখা হয়েছিল,
রিটায়ার করে
গেছেন।’ বাবাকে
জিজ্ঞেস করলাম
‘সরকার কতগুলো
নতুন স্কিম
তো করেছে,
রোজই খবরে
দেখাচ্ছে।
আমাদের জন্য
আলাদা করে
কিছু করেনি?’
বাবা প্রশ্নটা
বুঝতে পারেনি,
মুড়ি-মাখা
খাওয়া থামিয়ে
মুখের দিকে
তাকিয়ে ছিল। বাবাও
অবসর নেবে
এ বছরের
শেষের দিকে,
মফস্সলের
এক কলেজের
লাইব্রেরীয়ান।
আজকাল পুরনো
পরিচিত লোকদের
সঙ্গে দেখা
হলেও ডেকে
কথা বলতে
ইচ্ছে করে
না।
দুটো কেজো
প্রশ্নের পর
আর কিছু
বলারও থাকে
না।
মানুষ এমনিতে
খোঁজ রাখে
না, অথচ
খবর খুঁজতে
প্রশ্ন করে। না,
খুঁজতে না… খুঁড়তে। স্কুলের
বন্ধুরা, আত্মীয়রা,
তাদের ছেলে-মেয়েরা, প্রতিবেশীরা…
এমন কি
স্কুল বা
প্রাইভেট কোচিং-এর শিক্ষকরা পর্যন্ত
কেমন পালটে
গেছে সবাই। ‘কেমন
আছিস? বাড়ির
সবাই ভালো?
কী করিস
আজকাল? – শুধু এই তিনটে
প্রশ্নের বার
বার উত্তর
দেওয়া, আর
পালটা একই
কথা জিজ্ঞেস
করা, সম্পর্ক
আর সামাজিকতা
বলতে তবে
এটুকুই? আমার
আর জানার
নেই এইগুলো
বার বার। জানানোরও
নেই।
এই কথাগুলো
এখন মনে
পড়ার কথাই
না।
মনে পড়ে
গেল একজনকে
দেখে।
সিনেমা হলের
পাশের পুরনো
রেস্তোঁরার দিকে
রাস্তা পার
হয়ে আসার
সময়েই দেখেছিলাম… সাহা
স্যার।
প্রাইভেটে ফিজিক্স
পড়াতেন।
ওঁকে নিয়ে,
ওঁর অতীত
নিয়ে ওই
অঞ্চলে অনেক
রকম কথা
হত।
কখনো সেসব
আলোচনার অংশ
না হলেও,
কিছু কথা
তো কানে
যেতই।
ওঁর বামপন্থী
সংগঠনের সঙ্গে
যুক্ত থাকার
ব্যাপারটা ‘স্যার
নকশাল করতেন’ হিসেবে
প্রতিষ্ঠা পেয়ে
গেছিল অনেকের
কাছে।
অবশ্য আমার
সামনে কেউ
কখনো স্যারকে
এই নিয়ে
কোনো প্রশ্ন
করেনি।
তবে, স্যারকে
যেমন দেখেছিলাম… চিনেছিলাম,
তার ওপর
এই শোনা
কথাগুলোর একটা
প্রলেপ পড়ে
একরকম ভাবমূর্তি
তৈরি হয়ে
গেছিল মনে। এখনো
রাস্তায় এভাবে
দেখে ফেললে
বুঝতে পারি,
সেই কল্পিত
ভাবমূর্তির পরিবর্তন
হয়নি।
মাস্ক পরার
একটা সুবিধে
আছে এখন। সাহা
স্যারকে দেখে
ইচ্ছে করেই
মাস্কটা ভালো
করে টেনে
নিয়ে রাস্তাটা
পার হয়ে
গেলাম।
ওঁকে কিছুটা
পেছনে ফেলে
দ্রুত পায়
গিয়ে ঢুকে
পড়লাম একটা
ফাঁকা টেবিলে,
রাস্তার দিকে
পিঠ করে। এই
রেস্তোরাঁর মালিক
স্যারের অনেকদিনের
পরিচিত, আমি
জানি।
কিছু কেনার
না থাকলেও,
বিলিং কাউন্টারের
টেবিলে কনুই
রেখে সন্ধেবেলা
আড্ডা দিতেন। কিছুক্ষণ
পরেই স্যারের
গলার আওয়াজ
পেলাম, রুটি
আর চিলি-চিকেন পার্সেল চাইছেন। স্যারের
ছেলের বিয়ে
হয়ে গেছ
প্রায় ১৫
বছর আগে। মেয়েটা
আমাদের বয়সী
ছিল, ওরও
নিশ্চয়ই বিয়ে
হয়েই গেছে
এতদিনে।
তাহলে, স্যারের
ছেলে-ছেলের
বউ কি
স্যারের সঙ্গে
থাকে না?
নিজের রাতের
খাবার কিনে
নিয়ে যাচ্ছেন?
তা-ই
বা কেন… মানুষের
এটা-সেটা
খেতেও তো
ইচ্ছে হয়। হয়ত
সকলের জন্যই
কিনছেন।
কটা রুটি
বললেন…
চারটেই তো?
তাহলে? এইসব
ভাবছিলাম…
কিন্তু পেছন
ফিরে তাকাচ্ছিলাম
না, ঘাড়
ফিরিয়ে বাঁদিকেও
না।
ভেতরে মাস্কটা
খুলে বসেছিলাম,
কোনো ভাবেই
ইচ্ছে করছিল
না সাহা
স্যারকে নিজের
উপস্থিতি জানাতে। অসিত
স্যারের কথা
মনে পড়ে
গেল, অসিত
বাবুর বলা
কথাগুলো।
সাহা স্যার
তো নকশাল
ছিলেন, নকশাল
নাহলেও একটু
কড়া ধাঁচের
বামপন্থী…
এমন কি
ক্রিকেটেও বাঁ
হাতি বোলার
আর বাঁ
হাতি ব্যাটাররাই
ছিল ওঁর
বেশি পছন্দের
তালিকায়।
উনি এখন
কি একই
রকম আছেন?
একই রকম
ভাবে দেখেন
সব কিছু?
ষোলো বছর
আগের মতই?
জোট আর
নির্বাচন নিয়ে
স্যারের সঙ্গে
কোনো কথাই
হল না
কখনো…
আশ্চর্য!
একটা কাটলেট
অর্ডার দিলাম,
কাটলেট এলো,
খাওয়া শেষ
হওয়ার পথে… কিন্তু
সাহা স্যারের
পার্সেল এখনো
এলো না। একটু
অবাকই হলাম। কটা
রুটি আর
চিলি চিকেন,
এত সময়
লাগে? নাকি
এই নতুন
কর্মচারীরাও জানে,
সাহা স্যার
এসেছেন ঠিকই… তবে
পার্সেল পেলেও
এখন যাবেন
না।
হাতে পার্সেলটা
ধরিয়ে দেওয়া
মানে চলে
যেতে বলা। মনে
হল আরো
একজন কেউ
এসে দাঁড়াল
রেস্তোরাঁর সামনে। রেস্তোরাঁর
মালিক সহ
তিনজনের মধ্যে
কথা হচ্ছে। শীত
চলে যাওয়ার
কথা।
বাজেটের কথা। কোনো
কিছুই আর
আগের মত
না থাকার
কথা।
একবার আড়চোখে
দেখার চেষ্টা
করলাম…
স্যার মাস্কটা
চিবুকের কাছে
নামিয়ে নিয়ে
কথা বলছেন। অভিনেতা
প্রদীপ কুমারের
মত গোঁফটা
কামিয়ে ফেলেছেন। বয়স
বাড়ছে বলে?
খেতে খেতে
কয়েকবার রিহার্স
করার চেষ্টা
করলাম, স্যারকে
ডেকে কথা
বলার চেষ্টা
করলে কী
ভাবে শুরু
করব।
পায়ে হাত
দেব, না
দেব না। কী
কী জানাব
নিজের সম্বন্ধে?
কী কী
জিজ্ঞেস করব?
এইসব ভাবতে
ভাবতেও অসিত
বাবুর মুখটা
মনে পড়ে
যাচ্ছিল।
হাত দিয়ে,
দাম মিটিয়ে
বেরিয়ে এলাম। মাস্কটা
আবার তুলে
নিয়েছিলাম নাক
অবধি ঢেকে। স্যার
রেস্তোঁরা দিকে
পিঠ করে
দাঁড়িয়ে ছিলেন,
কথা বলছিলেন
সেই অন্য
লোকটির সঙ্গে। সেই
লোকটিও মনে
হল স্যারেরই
বয়সী, মাথার
চুল আর
দাড়ি একেবারে
সাদা হয়ে
গিয়েছে।
স্যার চুলে
কলপ করেন,
উনি করেন
না।
স্যারকে দেখে
এখনো মনে
হয় বয়স
পঞ্চাশের কিছু
বেশি…
অথচ পনেরো
বছর আগেই
ওঁর বয়স
ছিল ষাটের
কাছাকাছি।
সাহা স্যারের
পাশ দিয়েই
হেঁটে কিছু
দূর গেলাম। আবার
ফিরে এসে
ওঁর পাশ
দিয়ে হেঁটে
অন্যদিকে চলে
গেলাম।
দু-বারই
তাকালাম ওঁর
মুখের দিকে,
যেভাবে পথে
হাঁটতে হাঁটতে
কোনো পথচারী
তাকায়।
কিন্তু উনি
আমাকে লক্ষই
করলেন না। মনে
হল অন্য
লোকটির সঙ্গে
কথায় ব্যস্ত। লোকটির
কথা কানে
এলো ‘আমিও
ওই কথাই
বলেছিলাম…
গিয়ে দেখো,
ওরা কী
বলে।’ সেই
পরিচিত, অসম্পূর্ণ
সমস্যার সমাধান
খোঁজার ইঙ্গিত। সাহা
স্যারের পরিচিত
কণ্ঠ কানে
এলো, ঘুম
থেকে ওঠা
মানুষের মত
জড়ানো গলায়
বলছেন ‘উদ্ধার
করাটাই প্রবলেম’।
কয়েক মুহূর্তের
জন্য হঠাৎই
মনে হল
‘কী কী
চলে গেলে
আর উদ্ধার
করা যায়
না?’ উত্তর
ভাবতে ভাবতে
সাহা স্যার
আর রেস্তোরাঁকে
পেছনে ফেলে
এগিয়ে গেছিক
বেশ খানিকটা। এবারেও
স্যারের সঙ্গে
কথা বলা
হল না। আর
পাঁচটা কৃতী
প্রাক্তন ছাত্রর
মত পায়
হাত দিতে
দিতে ‘কেমন
আছেন স্যার… আমি
সেই…’
বলা হল
না।
আমি যে
উচ্চমাধ্যমিকে সাতশর
বেশি পেয়েছিলাম,
সেই অবিশ্বাসটুকুও
উনি লুকোতে
পারেননি।
সেইদিনই শেষ
কথা হয়েছিল
ওঁর সঙ্গে। আমি
একরকম নিশ্চিৎই– স্যার
আমাকে চিনতে
পারেন নি। মাস্ক
না পরে
থাকলেও পারতেন
না।
নাম বললেও
না।
পারতেন না
চিনতে।
আরও দু
তিনজনের নাম
বলতে হত,
যাদের মন
রাখার কারণ
থাকতে পারে।
— — — —
ছেলেটা একাই
পার্কে ব্যাট
আর বল
নিয়ে খেলছে।
ভেবেছিলাম রেস্তোরাঁ
থেকে হেঁটে
বাড়ি ফিরে
আসব।
কিন্তু ঘরে
ঢুকে বসে
থাকতে ইচ্ছে
করল না। পাড়ার
কাছাকাছি পার্কে
গিয়ে বসে
রইলাম।
এখানে মাঝে
এমন একা
মানুষও আসে। মোবাইল
ফোনের দিকে
তাকিয়ে বসে
থাকে, দোলনায়
দোলে, ফোনে
কথা বলে। একা
কেউ বসে
আছে বলে
তার দিকে
সন্দেহ অথবা
কৌতূহলের দৃষ্টি
নিয়ে তাকিয়ে
থাকে না
অন্যরা।
কনক্রিটের বেঞ্চে
বসে আছি,
কিছু দূরে
দোলনায় বসে
ছেলের খেলা
দেখছে ছেলেটির
মা।
ব্যাট আর
বল নিয়ে
একাই খেলে
যাচ্ছে ছেলেটা। আর
কোনো বালক
অথবা কিশোর
নেই পার্কে। খটাস
করে একটা
শব্দ তুলে
বলটা সজোরে
মেরে একদিকে
পাঠিয়ে দিচ্ছে। সেই
বল কোনো
দেওয়ালে ধাক্কা
খেয়ে কখনো
ফিরে আসছে,
আবার কখনো
দিক বদলে
চলে যাচ্ছে
অন্য কোথাও। সেদিকে
কেউই নেই,
যে বলটা
ছুঁড়ে ফেরত
দেবে ছেলেটাকে। আমি
হলে হয়ত
বার বার
এভাবে ছুটে
গিয়ে বল
আনতাম না। একা
একা খেলার
উৎসাহ আর
উদ্যম ক্ষয়ে
যেত একসময়ে। অথচ,
ওর যেন
এভাবেই একা
খেলার অভ্যেস
হয়ে গেছে। কিছু
দূরে চারটে
বাইক দাঁড়
করিয়ে রেখে
পাঁচ-ছটা
ছেলে নিজেদের
মধ্যে গল্প
করছে।
এদের মধ্যে
দুজন মুখ
চেনা…
স্থানীয় কাউনসিলরের
অফিসে বসে
থাকে।
আমারই বয়সী,
অথচ ওদের
নাম জানি
না, ওরাও
আমার নাম
জানে না। স্থানীয়
নেতারা কাছাকাছি
থাকতে থাকতে
ক্ষমতার রঙ
এসে যায়
শরীরী ভাষায়। বয়স
বাড়লে সে
রঙ আরো
পাকা হয়। মনে
হয় নিজেরাই
সরকারী আমলা। যদিও,
সবাই সেই
সরকারী আমলার
চেহারা বা
ভাবমূর্তিটা রাখতে
পারে না। ওটাও
একরকম স্কিল। এই
অল্পবয়সীরা কেউ
আমলা নয়,
এরা উঠতি। বাবা
এই পার্টি
অফিসের আমলাদের
কাছে গেছিল,
ঠিকানা বদল
আর ঠিকানার
প্রমাণ সংক্রান্ত
ব্যাপারে জিজ্ঞেস
করতে।
তারা নাকি
খুবই সহযোগী। আমাকে
সঙ্গে নিয়ে
গেল না,
যেতে দিল
না।
বলল–
দরকার নেই। যদিও,
কাজটা হয়নি
ওভাবে।
সুবিধে হয়নি
কিছুই।
অসিত স্যারের
কথা ঠিক
হলে, এখন
হলে হয়ত
সুবিধে হত
কিছু।
আসলে এই
ছেলেগুলোকে দেখলেও
নিজেকে অপদার্থই
মনে হয়। এদের
মত কোথাও
লেগে থাকতেও
পারলাম না। মাস্টার্স
করার পর
উচ্চশিক্ষার থেকেও
চাকরি বেশি
জরুরি হতে
পারে, মাস্টার্স
করার আগেও
চাকরিই প্রথম
প্রায়োরিটি হতে
পারে…
এটা অনেককেই
বোঝানো শক্ত। পদার্থ
বিজ্ঞানে অনার্স
করার সময়ে
ইচ্ছে ছিল
জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে
পড়াশুনো করব। এখন
ভাবি কোনো
গাইডেন্স আর
প্র্যাকটিকাল স্ট্র্যাটেজি
ছাড়া এমন
আঠাড়ো-উনিশ
বছর বয়সের
সিদ্ধান্তে কিছুই
পরিকল্পনা করতে
নেই! মা-বাবা এসব বোঝেন
না…
কে-ই
বা বলত?
তারপর দেখলাম
এই পার্কের
মতই একা,
ইউনিভার্সিটির কোনো
ঘরের বেঞ্চে
বসে আছি,
দিনের বেলাও
সেই ঘরে
আলো কম,
টিউবলাইটের আলো
নীল দেওয়ালকে
স্যাঁতস্যাঁতে ঠান্ডা
করে দেয়। পরিচিত
অন্যদের সব
ধাপে ধাপে
পরিকল্পনা করা,
এরপর ঐ
পরীক্ষা, তারপর
সেই অ্যাকাডেমিক
ধাপ, পিএইচডি,
পোস্ট ডক,
চাকরীর আবেদন,
বিদেশে যাওয়ার
পরীক্ষা…
সব রকম
ভাবে প্রস্তুতি
করা।
ফ্রাস্ট্রেটেড, অবসাদগ্রস্ত,
হীনমন্যতার স্বীকার
নাকি মাৎসর্য
রিপু ভেতর
থেকে ঘুণ
পোকার মত
কুড়ে কুড়ে
খাচ্ছে–
বুঝতে পারতাম
না।
ক বছর
যে যার
মত নিজের
অভীষ্ট লক্ষ্যে
এগিয়ে যেতেই
মনে হল
‘বন্ধু’
কথার কথা… আসলে
সেই স্কুলবেলা
থেকেই সকলে
সহপাঠী মাত্র,
আর ইউনিভার্সিটিতে
তো আরোই। আমার
ব্যর্থতা আর
বরফের চাঙরের
মত কঠিন
হিংসে…
আমাকেই পিষে
দিত রোজ। সত্যিই
হিংসের গড়ল
তীব্র।
মাংসের দোকানের
সামনে দিয়ে
গেলে মত
আমাকেই কেটে
ঝুলিয়ে দিচ্ছে। চপার
দিয়ে আমাকেই
কেটে কেটে
কিমা করা
হচ্ছে।
চারপাশের মানুষের
ভীড় যেন
শুধুই যোনি,
পায়ু আর
লিঙ্গ…
বসে, দাঁড়িয়ে,
হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছে।
কেউ মানুষ
না।
‘তিন ব্যক্তির
গুনাহ মাফ
হয় না,
তার মধ্যে
একজন হচ্ছে
অন্যের প্রতি
বিদ্বেষ পোষণকারী
ব্যক্তি।’-- হাদিসে
আছে।
স্কুলে যারা
আমাকে দেখেছিল,
তারা তেইশ-চব্বিশ বছরের আমাকে
দেখে চমকে
উঠত…
ভাবত অসুস্থ। ভাবত
কেন, অসুস্থই
তো! আরো
কয়েক বছর
পর দেখলাম
আরো অনেকে
চিনতে পারছে
না।
তার কয়েক
বছর পর
আরো অনেকে। ব্যক্তি
প্রতিষ্ঠিত হলে
নিজস্ব বৃত্ত
আর জগৎ
তৈরি হয়ে
যায়।
এক সময়ে
যাদের জন্য
স্বেচ্ছাসেবকের মত
উপস্থিতি থেকেছি,
নিজে কী
বা কেমন
তা না
ভেবেই
‘তব চরণে’ সঁপে
দিয়ে নিবেদিত
থেকেছি, একসঙ্গে
মিছিলে হাঁটব
বলে বিক্ষোভ
সমাবেশে গিয়ে
হাতের হাড়
ভেঙেছি, যাদের
জন্য সাহস
করে মাঝে
লিখেছি কবিতা
অথবা ব্যক্তিগত
গদ্য…
সেই সব
একতরফা ভালোবাসারাও
ভুলেই গেছে। যারা
বোঝাতে চেয়েছিল
কিছু হয়ত
অনুভব করে… তারাও।
আমারও এমন
একটি নিজস্ব
জগৎ থাকা
খুব দরকার,
তাহলে আমারও
‘না চিনতে
পারার’
একটা পাকাপাকি
ব্যবস্থা হয়।
ছেলেটা ঘামছে,
বল অন্যদিকে
চলে গেলে
এখন আসতে
আসতে যাচ্ছে
বল আনতে। ওর
মা পার্কের
দোলনা থেকে
উঠে দাঁড়িয়ে
বার-দুয়েক
ইতিমধ্যেই বলেছেন
‘সাড়ে আটটা
বেজে গেছে,
বাড়ি চল… এবার
কিন্তু মার
খাবি।’ ছেলেটি
বলল ‘আর
পাঁচ মিনিট’।
আমিও ভাবলাম,
আর পাঁচ
মিনিট।
অসিৎ স্যারকে
সেদিন বলা
হল না,
কৌশিক আর
নেই…
লিভার সিরোসিস
হয়ে মারা
গেছে।
সাহা স্যারকেও
জানাতে পারলাম
না অতনুর
কথা…
স্যার বোধহয়
জানেন, কাছাকাছি
অঞ্চলের পলিটিকাল
মার্ডারের খবর
কোনো না
কোনো উপায়ে
ঠিক চলে
আসে।
অতনুর ভাইকে
একটা চাকরি
পাইয়ে দিয়েছে… হত্যার
তদন্ত হয়নি,
এটাও হয়ত
জানে।
যেসব পরিবারে
চাকরি পাইয়ে
দেওয়ার মতও
কেউ নেই… সেসব
পরিবারে আন্দোলন
করে শহীদ
হওয়ার চিন্তাও
বিলাসীতা।
নাহ্… আমার
কথা বলছি
না, আমার
আর কী
যোগ্যতা।
কারো সাথে
ঝামেলা করে
মার খেলেও
কোনো পার্টির
কেউ গুরুত্ব
দেবে না। চেনা
হয় গেছে।
এরকমই একটা
পার্কে মাঝে
মাঝে সুদর্শনার
সঙ্গে বসতাম। কনক্রিটের
তৈরী ছাতার
তলায় বসার
ব্যবস্থা ছিল
বলে লোকে
বলত ছাতা
পার্ক।
রোদে-বৃষ্টিটে
সুবিধে ছিল। ওই
পাড়ার লোকজনের
অহেতুক খবরদারী
ছিল না। আর
কীই বা
করতাম আমরা?
একথা-সেকথা
বলতে বলতে
কিছুক্ষণ আমার
কাঁধে মাথাটা
রাখত।
আমি ওর
হাতটা আমার
দুটো হাতের
তালুর মাঝে
রেখে দিতাম
আলতো করে। এইটুকুই।
সুদর্শনা পলিটিকাল
সায়েন্সের ছাত্রী
ছিল, অন্য
কলেজে।
অ্যাকাডেমি চত্বরে
দু-তিনবার
দেখেছিলাম, আমাদের
কলেজের এক
ছাত্রীর কেমন
যেন বোন
হয়।
তারপর আলাপ-পরিচয় বাড়ল।
ও সবই
জানত।
আমিও জানতাম,
আমরা কেউ
কাউকে কথা
দিতে পারব
না।
আমি পারলেও,
ও পারবে
না।
ওকে বিব্রত
করতে চাইনি। ওকে
কোনো মিথ্যে
অজুহাত দিতে
হয়নি আমাকে,
ঘুরিয়ে অন্য
কথাও বলতে
হয়নি।
এমনকি, আঘাতও
দিতে হয়নি
রূঢ়ভাবে আয়নাটা
মুখের সামনে
ধরে।
ও জানে
আমি ওর
জন্য খুশি,
বিশ্বাস করে
কি না
জানি না। বিদেশে
থাকে, ওর
বর বিদেশেই
চাকরি করে… ফিলাডেলফিয়া। গতমাসে
ওর মা-বাবা গেছেন, সদ্যজাত
নাতনিকে দেখতে। মেয়ের
একমাস হতে
ছবি দিয়েছে। আমাকে
আনফ্রেন্ড বা
ব্লক করেনি,
শুধু বিয়ের
পর সচেতন
দূরত্ব বজায়
রাখে।
আমিও ওকে
কখন জিজ্ঞেস
করিনি কেমন
আছে।
দেখতেই তো
পাই।
মাঝে মাঝে
প্রোফাইল স্টক
করে আসি,
পুরনো ছবি
দেখে আসি। আমাদের
দুজনের কোনো
ছবি ওর
অ্যালবামে নেই… কোথাও
নেই আর।
এই পার্কেও
মাঝে মাঝে
জোড়ায় বসে
থাকে অল্পবয়সী
ছেলে-মেয়ের। তবে
এই অঞ্চলের
মানুষ খুব
একটা সহিষ্ণু
নয়।
নরম পেলে
নীতি-পুলিশ
হয়ে ওঠে। এই
কমাস আগেই
একটি অন্য
পাড়ার ছেলেকে
কলার ধরেই
বার করে
দিল।
সঙ্গে মেয়েটি
গোলমাল হচ্ছে
দেখে দূরে
মাথা নীচু
করে দাঁড়িয়ে
ছিল।
তারপর একসময়ে
পিছু হেঁটে
পার্কের অন্যদিকের
গেট দিয়ে
রাস্তায় গিয়ে
দাঁড়াল।
অপেক্ষা করছিল,
কখন ছেলেটা
হার মেনে
নিয়ে ফিরে
আসে ওই
দিকে।
ছেলেটি আর
মেয়েটিকে একসাথে
এর পরেও
আমি দেখেছি
এই পাড়ায়,
তবে এই
পার্কে আর
বসেনা ওরা।
সুদর্শনার বিয়ে
হয়ে যাওয়ার
পর আমি
কাদেরকে বলেছিলাম
কথাগুলো।
কাউকে একটা
বললে হালকা
হব মনে
হয়েছিল।
ওর ফ্ল্যাটের
ছাদে বসে
বটি কাবাব
আর বিয়ার
খেতে খেতে
হঠাৎই মনে
হল হলদেটে
চাঁদের দিকে
তাকিয়ে চুপচাপ
বসে না
থেকে কিছু
কথা বলি। একনাগারে
কাজের কথা,
ব্যবসার কথা,
ক্রিকেট আর
পলিটিক্সের কথা
শুনতেও আর
ভালো লাগছিল
না।
ও সব
শুনে বলল– ‘এই
জন্যেই বলি,
দুবাইয়ে চলে
আয়।
পাসপোর্ট ভিসা
রেডি করে
জাস্ট চলে
আয়…
লাইফটাই চেঞ্জ
হয়ে যাবে। এখানে
আছে টা
কী সালা?
অ্যাঁ? আমাদের
সালা কোনো
রেসপেক্ট আছে
এখানে? কেরালা
থেকে, বাংলাদেশ
থেকে, মুম্বাই
থেকে…
সালা এখন
এখানেও মালদা-মুর্শিদবাদ থেকে
পর্যন্ত মিডল
ইস্ট চলে
যাচ্ছে…
আর তুই
বাল পড়ে
আছিস এখানে!’
নেশার ঘোরে
বলছিল তা
নয়, ওর
জীবনে সত্যিই
আর্থিক উন্নতি
হয়েছে দুবাই
যাওয়ার পর। সেই
রোজগারের টাকাতে
নতুন ফ্ল্যাট
কিনেছে, যদিও
ইএমআই দিচ্ছে… তবে
সেটা মাসিক
দেওয়ার ক্ষমতা
অন্ততঃ ওর
আছে।
ওকে ওর
এক আত্মীয়
সুযোগ করে
দিয়েছিল।
তাকে বললে
নাকি আমাকেও
নিয়ে যাওয়ার
ব্যবস্থা হয়ে
যাবে।
এর আগেও
একবার বলেছিল… আমি-ই চাইনি যেতে। এখন
কেন জানি
না, সত্যিই
মাঝে মাঝে
মনে হয়– সত্যিই
কি আমার
এখানে কোনো
ভবিষ্যৎ আছে?
আমি কখনো
মদ খেয়ে
বাড়ি ফিরিনি। মেসে,
কলেজের হোস্টেলে,
পিকনিকে কিংবা
বেড়াতে গিয়ে… খেয়ে
সেখানেই রাত
কাটিয়েছি।
বাড়িতে কখনো
মাতাল হয়ে
ফিরিনি।
অথচ আজ
ভীষণ ইচ্ছে
করছে…
এক বছরে
দুটো লোক
মরল পুলিশের
উর্দি পরা
কারো হাতে। একজনের
নাম, মঈদুল
আর একজনের
নাম আনিস। দুজনেই
বামপন্থী দলের
সঙ্গে ছিল। কোনো
পাড়ার নীতি
পুলিশ আমাকে
সুদর্শনার সঙ্গে
ধরলে, সবার
আগে আমার
নাম জিজ্ঞেস
করত।
পাসপোর্ট করাতে
গিয়ে ক্লীন
শেভ করে
যাব ভেবেছিলাম,
কাদের খিস্তি
দিয়ে বলল– মিডল
ইস্টে যাবি,
দাড়ি কেটে
ফেলে?
ও ওর
চাচার সঙ্গে
কথা বলে
কিছুটা কাজ
এগিয়েই রেখেছে,
দুদিন আগেও
আইএসডি করেছিল
আমাকে।
কর্মী দিতে
পারলে রেফারেন্স
বাবদ কিছু
কমিশন পাবে… বুঝতে
পারছি।
অথচ আমি
পাঁচবার নামাজ
করা নামাজী
নই।
নাম জিজ্ঞেস
করে ট্রেনের
সহযাত্রী বলেন–
‘ও, তার
মানে মোহমেডান। বাঙালী
নয়।’ কতটা
বাংলা জানলে
বা বাঙালীত্ব
অর্জন করলে
বাঙালী হব
জানি না।
নাম জানার
আগে অবধি
আলাদা করে
কিছু বুঝতে
পারে না
আমার সহযাত্রীরা, সহনাগরিকরা।
নাম শোনার
পর বোঝে– আমি
বাঙালী নই। অথচ
আমি একেবারেই উর্দু কিংবা
ফারসী পড়তে
বা বলতে
পারি না। হিজরির
তারিখও মনে
থাকে না
আমার।
রোজা রাখি… না
রাখলে মায়ের
কষ্ট হবে
বলে।
দুবাইতেও কি
আমাকে কেউ
ভালো চোখে
দেখবে? কাদেরকে
জিজ্ঞেস করেছিলাম… একটু
গম্ভীর হয়েই
বলল, ‘এসব
বলতে যাস
না।
আমি তোকে
বুঝিয়ে দেব… কিছু
তো মেনে
চলতেই হবে। সবাই
মানছে, মানাই
তো উচিৎ!’
ছেলেটাকে ওর
মা প্রায়
হাত ধরে
টেনে নিয়ে
গেল পার্ক
থেকে।
আমিও মোবাইল
ফোনটা পকেটে
নিয়ে বেরিয়ে
গেলাম।
‘মদ পানকারী
জন্নতে যাবে
না’...
অনেকবার শুনেছি। মদ
পান না
করলেও আমি
জন্নতে যেতাম
না।
ধুর!
গেটের
তালা বাবা-ই এসে খুলল,
আমার মনে
হল সিঁড়ির
প্রথম ধাপে
পা-টা
ঠিকঠাক পড়েনি। পেছন
ফিরে বাবার
দিকে তাকানোর
সাহস পেলাম
না।
মাথা নীচু
করেই আসতে
আসতে সাবধানে
পা ফেলে
দেওয়ালে হাত
রেখে রেখে
ওপরে চলে
গেলাম।
আমরা দোতলায়
ভাড়া থাকি,
একতলায় দোকানদের
ভাড়া দিয়ে
রেখেছে বাড়িওয়ালা। নীচে
দোকান বলে
মা এই
বাড়িতে আসার
পর থেকে
গলা তুলে
ঝগড়াও করতে
পারে না
বাবার সঙ্গে। সব
সময়ে চিন্তায়
থাকে–
ঘরের কথা
বাইরে চলে
যাবে।
বাবা, আবার
কোলাপসিবল গেট
টেনে তালা
দিয়ে দিল,
শুনতে পেলাম। চুপচাপ
নিজের ঘরে
চলেই যাচ্ছিলাম,
হঠাৎই মনের
ভেতর কিছু
একটা মুচড়ে
উঠল একটা
সদ্য খুন
হওয়া ছেলের
মুখটা মনে
পড়ে।
নিজেকে আর
জিভটা যতটা
পারি সামলে
নিয়ে বললাম– ‘আচ্ছা,
বাবা…
অনেকেই বলে
শুনি তিন-চার পুরুষ আগেও
নাকি আমরা
হিন্দু ছিলাম। সত্যি?’
বাবা ধাপে
ধাপে সিঁড়ি
দিয়ে উঠতে
উঠতে থমকে
দাঁড়িয়ে গেল,
আমার দিকে
তাকিয়ে রইল… কিছু
বলল না। আমি
আবার জিজ্ঞেস
করলাম…
‘আচ্ছা, এই
এনআরসি যে
হচ্ছে…
এতে নিজের
বাড়ি না
ভাড়া বাড়ি,
এসব ম্যাটার
করবে? আমাদের
তো ভাড়া
বাড়ি…
এর আগে
যেখানে থাকতাম… তার
আগে কোথায়
থাকতাম…
আমরা সবাই
মিলে দুবাই
চলে গেলেও
এনআরসি হবে?’
বাবা কেমন
অদ্ভুত ভাবে
চোখ বড়ো
বড়ো করে
আমার দিকে
তাকিয়ে রইল। যে
হাতে চাবি
ধরা, সেই
হাতটা কাঁপছে
মনে হল। কেমন
কাঁপা স্বরেই
শুধু বলল
‘আ-ল-তা-ফ!’
অজ্ঞাতনামা দিদিমা
পারমিতা সাহা
বারান্দায় বসে বিকেলবেলা সুচেতনা রোজ রাস্তা দেখে। এই সময়েটা কেউ থাকে না
বাড়িতে। এটা তার নিজেস্ব সময়। হুইলচেয়ারেই তার জীবন। আজ থেকে পনেরো বছর আগে ওর পা দুটো গাড়ি দুর্ঘটনায় চলে যায়। সেই
থেকে এই ভাবেই চলে। প্রথম প্রথম নিজের মেনে নিতে খুব কষ্ট হত যে ওর পা নেই। কত
অসুবিধা পরতে হত। কেবলই মনে হতে থাকত ও যেন বোঝা হয়ে গেছে সবার।
যাক সে কথা। কি হবে ভেবে। বত্রিশ
বছরে পড়ল সে। দুদিন আগে জন্মদিন ছিল। বাপি তাকে অনেক গুলো গাছ উপহার দিয়েছে।
সেইগুলো বারান্দায় রেখেছে। বাগানটা ভীষণ সুন্দর হয়েছে। কত ধরনের ফুল আর বাহারি গাছ
যে হয়েছে।
গত দুতিন বছর ধরে আবার সবজি গাছ ও
বুনছে।
লঙ্কা, টমেটো, ঢ্যাঁড়স,বিভিন্ন ধরনের শাক, বেগুন, পাতিলেবু, বাতাবিলেবু- কত কি যে গাছ আছে তা বলা যাবে না।
এদের বড় হওয়াগুলো সুচেতনা লক্ষ্য
করে।
সকাল থেকে রাত অবধি এরাই তার ভাবনার
বিষয়।
এরা তার ভালোবাসা।
একটা কথা তো বলাই হয়েনি। মা তাকে
দুবছর হল চন্দনা পাখি এনে দিয়েছে। সারাদিন সে ডাকে সুচেতনা বলে। আজকাল কেউ নাম ধরে ডাকে না। মা, বাবার অফিস। ভাই কলেজে পড়ে। আর বোন ও চাকরি করে। ভাই আর
বোনকে সে কতদিন দেখেনি। তারাও আসে না। প্রথম প্রথম সে যেত কিন্তু দেখত ওরা কেমন অস্বস্তি
বোধ করছে। ওদের মতো স্বাভাবিক জীবন তো ওর নয়। তাই ওরা ঠিক দিদিকে বোঝেনি। আর সেও
চেষ্টা করেনি বোঝাতে।
জীবনে যে পিছিয়ে পরে তাকে সঙ্গে নিয়ে
কেউ চলে না। বরং পিছিয়ে পড়া মানুষটি তাদেরকে সব বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিয়ে নিজের
মতো করে বাঁচতে শেখে। সুচেতনাও তাই শিখেছে।
লড়াইতা ভীষণ কঠিন ছিল। মনের মধ্যে
একটা ব্যথা অনুভব করত সে। সবার অনুগ্রহ নিয়ে তাকে বাঁচতে হবে, বাকি জীবন এই ভাবনাই তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেত। এখন কোথায় সেই
ভাবনা। এগুলোকে সে মনে আসতেই দেয় না।
তার ঘরে সকালে রোদ আর ছায়ার খেলা
চলে। কখনো সে হুইলচেয়ার নিয়ে রোদে যায় আবার কখনো ছায়ায়। ভারী মজা
লাগে তার। প্রকৃতির সাথে লুকোচুরির খেলা চলতেই থাকে।
দোতলায় ফ্ল্যাটে থাকে সে। কদিন ধরে
এই বিকেলে তার এক দিদিমার সাথে আলাপ হয়েছে। প্রথমে কদিন তো শুধু হাসি হাসি মুখ আর
হাত নাড়া ছিল। তবে হাসতে গিয়ে সে লক্ষ্য করেছে তার গালে ব্যথা করছে। বহুদিন সে
হাসেনি। বাড়িতে হাসি ঠাট্টা হয় কিন্তু সে গেলেই সবাই কেমন বেদনাবিদুর চোখে তার
দিকে তাকিয়ে থাকত। তাই বাইরে ডাইনিং এ বেরোনো সে বন্ধ করে দিয়েছে। ওদের কে এই অস্বস্তি থেকে
মুক্তি দেবার জন্য।
এখনতো সে রোজই হাসে বিকেলে । আবার
তিনদিন হল গল্প হচ্ছে দিদিমার সাথে। অত জোরে তো কথা বলা যায় না। তাই বারান্দা থেকে
যে ব্যাগটা ঝুলানো থাকে তাতে দিদিমাই একদিন তার মোবাইল ফোন নাম্বারটা লিখে
দিয়েছিল। সুচেতনা সেই ব্যাগটা থেকে নাম্বারটা নিয়ে নিজের ফোনে সেভ করে নিয়েছে। সেই
থেকেই কথা। দুজনের ফোনে কথা অথচ দুজনেই দুজনকে দূর থেকে দেখতে পায়। কথাটা ফোনে
কিন্তু অবয়ব দুটো সামনে।
বিকেলে যেই পাঁচটা টা বাজে দিদিমাকে
না দেখলে সুচেতনার কেমন যেন করে। গাছে কি কি সবজি ধরেছে সব সে বলে দিদিমাকে। কেউ
যে তার কথা শুনতেই চায়নি এতদিন। মা আর বাবা সময় মতো এসে দেখে যায় সে খেয়েছে কিনা।
কিছু লাগলে সে একটা লিস্ট করে দেয়। সেই অনুযায়ী পরের দিন জিনিসপত্র সব চলে আসে।
সে একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে দিদিমা
নিজের সম্বন্ধে কিছুই বলে না। যতবার সে জিজ্ঞাসা করেছে দিদিমা তোমার কে কে আছে
বাড়িতে?
দিদিমার সেই একই উত্তর- "বাড়িতে
আমার অনেক লোক, একান্নবর্তী পরিবার। সারাদিন হৈ
হুল্লোড় হয়ে। বরং তুমি তোমার কথা বল। তোমার গাছেরা কেমন আছে? আজ কি করলে?"
সুচেতনা নিজের কথা বলার লোক পায় না
বলে কেউ এত আদর করে জিজ্ঞেস করলে, সে অকপটে সারল্য
মিশ্রিত কন্ঠে তার গাছের কথা, নিজের কথা বলে যায়।
একদিন সে দিদিমাকে জিজ্ঞেস করেছিল
প্রতিদিন তিনি একাই আসেন কেন?
তাতে দিদিমার উত্তর কেউ সঙ্গে এলে
তাদের একান্ত মুহুর্ত নষ্ট হয়ে যাবে।
সুচেতনা অনেক কিছু ভাবে। দিদিমার
হাসিটা বড্ড মিষ্টি। কত কথা বলা হয় না। মনের গভীরে যত অব্যক্ত কথা তা যেন আগল ছেড়ে
বেড়িয়ে আসতে চায়।
দুপুরবেলায় তার ঘুম আসে না।
সকালবেলায় কাজ থাকে তার। আর যেহেতু সে আর চার পাঁচজনের মতো নয় তাই তার প্রতিদিনের
কাজ করতে সময় লাগে। কিন্তু আজ কাল তার সব কিছুর মধ্যে আর সেই একঘেঁয়েমিটা নেই।
সেটা সুচেতনা লক্ষ্য করেছে। মনের আগল পাওয়া ভার। কিন্তু দিদিমা বলে যে, আমরা যে রকম ভাবি সেই সবই বাস্তবে ঘটে। যদি আমরা ভাবি
আনন্দে থাকব তাহলে আমরাই সেটা পারি। মনই আসল। আজকাল সুচেতনা ও তা বিশ্বাস করতে
শুরু করেছে। রাতের খাবারটা সে এখন সবার সাথে খায়। তার ও মনে হয় না আজকাল তার ভাই
বোন তাকে করুণাপ্রার্থী হিসাবে দেখছে। আর যদিও বা দেখে তার দৃষ্টিভঙ্গি এখন পাল্টে
গেছে। সব কিছুই হয়েছে দিদিমার জন্য। মাঝে মাঝে সে ভাবে দিদিমা কেন বলে সে, ঠাকুমা নয় কেন? আসলে ছোট বেলায় দিদিমা তার খুব কাছের ছিল। আর তার নিজের দিদার সাথে এই দিদিমার
মুখের অদ্ভুত একটা মিল আছে। কি স্নিগ্ধ মুখখানি। খুব ইচ্ছে হয় একবার দিদিমাকে
ফ্ল্যাটে নিয়ে এসে সামনে বসাই। কেয়া কে বললেই হয়। কিন্তু কেয়া যদি আবার মা বাবা কে বলে। তবে কেয়া দুদিন হাত নাড়া দেখেছে। আবার ফোনে কথা বলতেও
দেখেছে কিন্তু সেটা যে দিদিমার সাথে বোঝেনি। মাসির মেয়ে আর পিসীর মেয়ে ফোন করে
কিনা তাই ওর মাথায় আসেনি দিদিমার কথা।
আজ প্রায় একমাস হয়ে গেছে দিদিমা আসে, সেই একই ভাবে কথা হয়। রোজ পনেরো মিনিট কথা হয়। একদিন সুচেতনা প্রশ্ন করেছিল
দিদিমা রোজ এই রাস্তায় আসে কেন? তাতে দিদিমার কি
হাসি,
উত্তর দিল "তোকে না দেখলে যে ঘুম হয় না নাতনি। তোকে
অনেক কিছু ভাল ভাবতে হবে। তোকে অনেক কিছু শিখতে হবে। "
এই একটা পঙ্গু মেয়ে এখন কি শিখতে
পারে। কিন্তু না। ওর যে পরিবর্তন এসেছে সেটা ও বোঝে।
ভাল লাগে। পৃথিবীটা এত মিষ্টি লাগে, এত সুন্দর গন্ধ আছে ভুবন জুড়ে তা সুচেতনা জানতই না।
চন্দনা কত কি কথা শিখেছে। খুব বকবক
করে। সারাদিন সুচেতনা আর সুচেতনা। আবার ঠিক মতো ঔষধ খাচ্ছে কিনা
তাও প্রশ্ন করে। দেখতে যদি না পায় তাহলে আর রক্ষা নেই, ডেকে ডেকে পাড়া মাথায় তুলে দেয়। কেয়া মাঝে মাঝে বকে। আসলে কেয়ার অনেক কাজ। তার
মধ্যে যদি কেউ সমানে ডেকে যায় তাহলে কি ভালো লাগে।
কদিন ধরে বৃষ্টি পড়ছে। দিদিমা আস্তে
পারছে না।তাই বিকেলটা সুচেতনা সাদা কাগজে কিছু শব্দের আঁকিবুঁকি কাটছে। অনেকবার
ভেবেছে ডায়েরি লেখা শুরু করবে। ওই কালে পায়ে লোকের। কাল করব, সে কাল আজও আসেনি। এই সাদা কাগজই ভালো। আনমনে লিখতে লিখতে
সে খেয়াল করেছে যে সাদা কাগজে কত সুন্দর সে লিখেছে।
"আমি সুচেতনা আমার কোনো পরিচিতি আগে
ছিল না। এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে আমার নিজস্ব পরিচিতি দরকার। আমার দুটো ডানা আছে যাদের
উপর ভড় করে আমি উড়তে জানি। গাছের পাতায় হাত দিয়ে যেমন সতেজটা অনুভব করা যায় তেমনই
আমার জীবনে দিদিমার জন্য আমার অনুভূতিগুলো অন্য মাত্রা পেয়েছে। তোমাদের বলা হয়েনি
এই দিদিমা কে? কি তার নাম? এই যা আমিও তো নাম জানি না।"
সত্যিই তো দিদিমার নাম জানা হয়েনি।
বৃষ্টির সঙ্গে কোনো সর্ম্পক নেই নাম না জানার। ফোন করলেই হয়। ভুলেই গেছে। অভ্যাস এমন একটা জিনিস। রোজ এখানে দেখা হলে ফোন
করে এবার না হয় সামনে নাই বা দেখা হল কথা তো বলা যায়। যেমন ভাবা সেই কাজ। ফোন করল।
দিদিমার নাম্বার বন্ধ।
পরের দিন চেষ্টা করল তাও বন্ধ। কি
হচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। এদিকে বৃষ্টি ও ছাড়ে না। রাস্তায় জল উঠেছে। ফুল ধরেছে
গাছে। দিদিমাকে কত কি বলার আছে কিন্তু না ফোন পাওয়া যাচ্ছে, না বৃষ্টি কমছে।
দশদিন কেটে গেল। ওর সাদা পাতাগুলো
অনেকটাই ভরে উঠেছে লেখায়। এদিকে বৃষ্টিও থেমেছে কিন্তু তাও বিকেলে দিদিমা আসছে না।
কি যে হল কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কেয়া কে একদিন বলল দিদিমার কথা। কেয়া নাম জানতে চাইলে কোনো উত্তর দিতে পারল না।
একমাস হয়ে গেল। সুচেতনা অপেক্ষায়
থাকে রোজ বিকেলে। না, দিদিমা আর এলো না।
মন খারাপ করে নি সে। দিদিমা বলত, "খারাপ ভাবলেই খারাপ
আর ভালো ভাবলেই ভালো। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষণে আমরা ভালো, শুধুই ভালোই ভাবব। জীবনে যা পেয়েছিস সুচেতনা তার জন্য
কৃতজ্ঞ থাক দেখবি জীবন তোকে ভরিয়ে দেবে।"
কত কি যে শিখেছে সে দিদিমার থেকে।
এদিকে ওর লেখাটাও শেষ হয়েছে। নাম দিয়েছে - 'প্রত্যাবর্তনে
আমি"।
বাবাকে দিয়ে সে লেখাটা কাগজের অফিসে
পাঠিয়েছে।
"দিদি দিদি" ভাই এসে জড়িয়ে ধরল।
বোন ও এসেছে। মা বাবা সবাই।
কতদিন এরা ডাকেনি তাকে। আসেনি তার
ঘরে। এত আনন্দ আছে আকাশে, এত রঙ আছে জীবনে সুচেতনার জানাই ছিল না। সমস্ত জগৎ জুড়ে একটাই ডাক সে শুনছে- সুচেতনা
দিদিমার নামটা শুধু তার কাগজের লেখায়
ছাপা হল না।
একটি অলৌকিক দিন ও রাত
খুকুমণি বাগ
মাটির ঢেলা টা পড়ে আছে যাওয়া আসার
পথের একেবারে মাঝখানে। রুকুদের বাড়িতে দুটো রান্নাঘর। একটি ঘরের ভেতরে আর একটা ঘর
লাগোয়া,
একটু বাইরে।দুটি রান্নাঘরের মাঝে একটি গোয়ালঘর।গোয়ালে গরু
থাকত আগে। এখন আপাতত নানাজাতের খরগোশ আর পাখির চাষ।দরজা বরাবর একটা সরুগলি আছে,সেটা দিয়েই আসা যাওয়া করা হয়। আজকে রুকুর মা বাড়িতে
নেই। দিদির ছেলের জন্মদিন।তাই সেখানে যেতেই হয়েছে। নাহলে ওই পৌষের শেষে আর মাঘের
শুরুটা ওর মা ওকে একলা রেখে কোথাও যায় না। ওদের বাড়ি টা বেশ বড়। দোতলা বাড়ি,চারটে ঘর।একটা ঘরেই ওরা মা মেয়ে থাকে। বাকি গুলোতে চাল ধান
থাকে। সমস্ত ঘর ভরে আছে চাপ চাপ অন্ধকারে।এই শীতের সময়টা পরপর ওদের বাড়িতে অনেকগুলো
মৃত্যু ঘটেছে। প্রথমে ঠাকুমা মারা গেলো প্রখর রৌদ্রে,তারই কয়েকমাস পর বাবা মারা গেলো পৌষে আর দাদু মরলো বাবার
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই।মৃত্যু গুলো নেহাতই কারন যুক্ত। কিন্তু রুকুর মা বলে ওদের এই
বাড়িতে নাকি ছেলে টিকবে না। গণকঠাকুর নাকি এসে বলে গেছে ওদের বাড়ির দরজাটি ঘরের যে প্রান্ত বরাবর,ঐদিকে দরজা হলে নাকি মেয়েদের কাঁদতে হবে বেশি।রুকু এসব পাত্তা
না দিলেও ওর মা দেয়।
মাটির ঢেলা টা একেবারে ছোটো, হাতে তুলে ছুঁড়ে দেওয়া যাবে চন্দ্রের পুকুরে। কিন্তু পা দিয়ে সরিয়ে দিতেও ইচ্ছে করছে না ওর। কেন ইচ্ছে করছে না তার কারণ টা ওর নিজেরও কাছে ধরা দিয়েও দিচ্ছে না। বারবার ওটাকে ডিঙিয়ে হাঁটছে ও।
প্রথম যখন ও ঢেলা টা দেখেছিলো
তখন অনেক ছোট ছিলো। দ্বিতীয়বার যখন দেখেছিলো সেটা খানিক টা বড় বড় হয়েছে। হয়ত ওটা বড়ই
ছিলো।ও হয়ত খেয়াল করে নি। কিন্তু তৃতীয়বার ওর অবাক হওয়ার পালা। হাতে মশলার ঝুড়ি নিয়ে
যখন ঘরে ফিরছে তখন ও দেখলো মাটিটা আরো বড় হয়েছে এবং পোড়া পাঁকের তৈরি একটা হাতের
আকৃতি নিচ্ছে। রুকুর নিজস্ব চেতনা যেন লোপ পাচ্ছে আর ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছে
ক্লাস সেভেন এ পড়ার সময়কার একটা অমাবস্যার রাত।
রুকু যখন সেভেনে পড়ে তখন ওদের
টিভি টা ছিলো হলঘরে। বাবা মারা গেছে সবেমাত্র চার পাঁচ মাস হলো। গরমের দিন এলে
মেঝেতে গড়াগড়ি দেওয়া ওর স্বভাব।টিভি টা তখন চলছিলো। ঘড়িতে বাজে সাড়ে আটটা। কোনো একটা
ধারাবাহিক চলছিলো। সেটার বিরতির সময় ও টিভির থেকে মুখ সরিয়ে জানালার দিকে মুখ
করে চিত শুয়ে পড়েছিলো। তখন হঠাৎ ও জানালায়
দেখতে পেলো একটা অস্তিত্ব শূন্য হাত, ঠিক আজকের
পোড়া পাঁকের মত রঙের একটা পাঁচ আঙুল এর হাত তুক করার ভঙ্গীতে অনবরত ঘুরিয়েই চলেছে,ও যেন আর অন্য কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছে না। পৃথিবীতে যেন আর
কোনো শব্দ নেই আর কোনো দৃশ্য নেই ওই হাত টা ছাড়া। রুকু তাকিয়েই আছে।
আজও তেমন করে হাতটা মাটি থেকে উঠে এসে মুখের সামনে তুক করার ভঙ্গীতে হাতের আঙুল গুলো ঘুরিয়েই চলেছে রুকুর মুখের সামনে। আর রুকু যেন অনুভব করছে ও একটা ঠান্ডা মেঝের ওপর শুয়ে আছে সেই অমাবস্যার রাত টার মত।
দুটো গল্পই ভালো। দিদিশাশুড়ীর..... টা মজার বেশ। আর ফানুস যেন একটা কবিতা। উঠে দাঁড়ানোর গল্প।
ReplyDeleteহারিয়ে যায় দিন গুলো শুধু, প্রেম থেকে যায়। তাই প্রেমিক থেকে বর হয়েও মানুষ টা থেকেই যায়! খুব ভালো লাগল দিদিশাশুড়ি...
ReplyDelete