
ইন্টারভিউ আর সেলিব্রিটি আজকাল সমার্থক। কিন্তু তার বাইরেও সাধারণ কিছু মানুষের ভেতরে রয়ে যান অসাধারণ কিছু মানুষ। তাই 'তারাদের কথায়' না গিয়ে আমরা খুঁজে আনলাম 'তাহাদের কথা' : কলকাতার নলিন সরকার স্ট্রিট এর বাসিন্দা সুশীল কুমার চট্টোপাধ্যায়।তবে ওনাকে সবাই নকু বাবু নামেই চেনে। স্বাধীনতা প্রত্যক্ষ করেছেন। সারাজীবন ধরে তিলতিল করে সংগ্রহ করেছেন দুর্লভ সব জিনিস। শব্দ বা সাউন্ড নিয়ে সারাজীবন কাজ করেছেন। লাইভ অডিও রেকর্ডার বানিয়েছেন। তার সংগ্রহে আছে তালবাদ্য, বিভিন্ন পুরোনো লণ্ঠন, ৩৫এমএম ফিল্ম প্রজেক্টর, yashica ক্যামেরা, আরো কত কি! সেই ঘরের নাম রেখেছেন 'অতীতের আশ্রয়'... তার সুদীর্ঘ জীবনের নানা মণিমাণিক্য তুলে আনলেন রোয়াকের সঙ্গে এই একান্ত আলাপচারিতায়। বয়স ৯৩ হলেও মনে প্রাণে ও স্মৃতিতে এখনও তরুণ।
রোয়াক : স্বাধীনতার সময়কার কোনো অভিজ্ঞতা ?
সুশীল বাবু : আমি ভারত ছাড়ো '৪২ মুভমেন্ট এর মানুষ। '৪২ মুভমেন্ট
এর ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্ন বলতে যেটা দেখেছিলাম -স্বপ্নটা এতো ভালো করে বুঝিনি তখন
- স্বাধীন হব আমরা পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বেরোবো অর্থাৎ আমরা নিজেদের ভালোমন্দ নিজেরাই
বুঝে নিতে পারবো। অপরকে বুঝতে দেবোনা। তার পরিনাম যে এতো সাংঘাতিক হবে সেটা বোধগম্য হয়নি। স্বাধীনতা
সংগ্রামে যারা আন্দামান এর সেলুলার জেলে ছিল তাদের ৮০-৯০% বাঙালি। কিন্তু সেগুলো সব
মুছে গেলো। আমরা এখন এমন অবস্থায় আছি যেখানে সব দিকদিয়ে আমাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা, কণ্ঠ সব রোধ করে দেওয়া হচ্ছে। এই 'স্বাধীনতা' আমাদের ব্যক্তিগত জীবনেও ঢুকে গেছে। এই 'স্বাধীনতা' যুবসমাজকে সৃষ্টিমূলক কাজকর্ম কিছুই
করছে দিচ্ছে না। এই স্বাধীনতায় আমরা পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ভুলে গেছি। স্বাধীনতার আগে আমার বাল্যজীবনে আমি দেখেছি মানুষ নিজেকে ব্যক্ত করতে পারতো। ব্রিটিশ গভমেন্ট এর কাছে পরাধীন ছিলাম ঠিকই কিন্তু
তখন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ভালো ছিল। মেরিট থাকলে তুলে ধরতো। বোঝার ওপর বোঝা চাপিয়ে মানুষ
কে পিষে দেওয়া যায় যাতে মসনদ গুলো ঠিক থাকে, যাতে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের স্বার্থ সিদ্ধি হয়। ভাবতে গেলে কান্না পায় যে এখনকার যুবসমাজের ভবিষ্যৎ বলে কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। অন্য
বস্ত্র সংস্থান মুশকিল হয়ে উঠেছে।
দ্বিতীয়ত আরো একটা জিনিস, বিজ্ঞানের উন্নতি হচ্ছে, ভালো। কিন্তু ম্যানুয়াল প্রযুক্তি না
থাকলে দুদিক দিয়ে ক্ষতি হবে। একটা ক্ষতি হবে বেকার সমস্যা আরো বাড়বে। দ্বিতীয়ত মানুষের শারীরিক গঠন, মানসিক চিন্তা ভাবনা সব হারিয়ে যাবে। নতুন যুগের বিজ্ঞান
মানুষকে স্ত্রৈণ করে দেবে। সৎচিন্তা থাকবে না। এ একটা drug addiction এর মতো। আমার বলাটা হয়তো ধৃষ্টতা কিন্তু আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি এটা কি হচ্ছে। এখনকার দিনে কেউ কি চিন্তা করতে পারবে যে একটা গাছ কথা বলে। কিন্তু এটা আমাদের জগদীশ বোস দেখিয়েছেন যে একটা বেগুন ক্ষেতে যদি একটা গরু ঢুকে পরে বেগুন গাছ গুলো ভয়ে খানিকটা হেলে যায়। কাজেই প্রকৃতির
সান্নিধ্যে থাকাটা মানুষের কাছে জরুরি। তোমরা হয়তো জানবে না জাপান ধান চাষের ক্ষেত্রে হার্প বাজাতো কারণ
ওই ফ্রিকোয়েন্সিতে গাছের ডেভেলপমেন্ট হতো। প্রকৃতির লীলায় যে বিজ্ঞান
আছে তাকে বাদ দিয়ে আমরা অঙ্ক কষে প্রকতির লীলা কে ব্যক্ত হতে দিচ্ছি না। যেমন দেখা যায় বিভিন্ন ঋতুতে পোকামকরেরা বিভিন্ন আচরণ করে। এগুলোই প্রকৃতির লীলা। আজকাল যুবসমাজ কি এসব জানে? এদের কাঁধে বস্তা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, গুচ্ছের সাবজেক্ট এর চাপে গঠন ব্যাহত হচ্ছে। উচ্চ শিক্ষা
করে প্রচুর পয়সা রোজগার করতে পারে কিন্তু তা নিয়ে কি করবে ? চিবিয়ে খাবে ? প্রকতির সাথে
মন ও মানুষের সান্নিধ্য থাকাটা জরুরি। জীবনের গতি বেড়েছে সাথে বেড়েছে অবক্ষয়। গতি বাড়ার
ফলে মানুষ অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছে। একটা স্লো acceleration এর গাড়ি অনেকদিন চলে কিন্তু কুইক acceleration এর গাড়ি বেশিদিন চলে না। এখনকার শান্তিনিকেতনে সেই লেখাটা কি হবে? প্রকৃতি
কে বাঁচিয়ে রাখতে হবে তবেই পৃথিবী বাঁচবে মানুষ বাঁচবে। নয়তো মানুষ রোবট হয়ে যাবে। হয়েই গেছে।
রো : কিভাবে কালেকশন এর জগতে প্রবেশ?
সু : পোকামাকড়ের জীবনযাত্রা দেখা, রকমারি প্রজাপতি জমানো, গাছের পাতা এই সবের মাধ্যমে। বিভিন্ন গাছের ভেতর থেকে হাওয়া চলে বাতাসের বিভিন্ন
শব্দ হয়। এই সম্মিলিত শব্দ নিয়ে টোটাল ইকোলজি তৈরী হয়। এই সম্মিলিত শব্দের সংস্পর্শে শ্রবণেন্দ্রিয় প্রখর হয়। মৌমাছির ডানার আওয়াজ শোনা , সাঁওতালদের মাদল বাজার ভেসে আসা আওয়াজ, শব্দের পরিক্রমণ অদ্ভুত লাগতো। রেডিও
তৈরী করলাম ১৯৩৬ থেকে করতাম। সুভাষবাবু সাইগণ থেকে বক্তৃতা দিতেন, রেডিওতে শুনতাম। শব্দ নিয়ে কাজ করতে করতে একটা ধারণা এলো যে আমরা বলি শব্দই ব্রক্ষ্ম, শব্দ সৃষ্টি করে শব্দ
ধ্বংসও করে। এই ধারণা থেকে অডিও ফ্রিকোয়েন্সি এমপ্লিফায়ার বানালাম যার থেকে লাইভ পারফরমেন্স পাবো। তবলার হাত ঘষার আওয়াজ, মৌমাছির ডানার আওয়াজ
সবই পাবো তাতে। এছাড়াও যে জিনিস গুলো আমার ঘরে দেখছো সেগুলোর প্রতিও একটা আগ্রহ জন্মালো কারণ সেগুলো মানুষ তৈরী করেছিল ম্যানুয়াল প্রযুক্তিতে, এমন কিছু অঙ্ক কষে নয়। এগুলো আমার খুব ভালো লাগতো। শব্দের সাথে রঙের যোগাযোগ খুব বেশি। সাতটা রং সাতটা আলাদা ফ্রিকোয়েন্সি। শব্দ ও
আলো একসাথে যুক্ত। সূর্য্যের ভেতরে অ্যাটমিক ফিউশন হচ্ছে সেটাই রশ্মি হয়ে এখানে আসছে। মানুষ এর থেকে কোনোদিন
নিষ্কৃতি পাবে না। এটাই হচ্ছে কর্মযোগ। যে যদি সৎ সে যদি ভালো হয় তাহলে মহাবিশ্বের এই চৌম্বক রহস্য দিনে দিনে তাকে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেবে। কিন্তু তার মনের ভেতর যদি বিকৃত চিন্তা থাকে তাহলে এই ম্যাগনেটিক ফিল্ড তাকে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেবে না। জীবন পরতে পরতে উপলব্ধি করতে হবে। জীবন শুধু ভোগের জন্য নয়। জীবনে খিদের কষ্টও জানতে হবে, শীতের কষ্টও জানতে হবে, অপমানিত হতে হবে তাহলে জীবনটাকে বোঝা যাবে, বোঝা যাবে জীবনের মূল্য কতটা।
রো : আপনার পছন্দের কালেকশন?
সু : পছন্দের ভেতরটা সবই। আসলে ভেতরের সত্ত্বা
সবার জন্যই এক থাকে। সংগ্রহের জন্য প্রয়োজন আকুলতা। সবকিছু ছেড়ে আকুল হয়ে নিজের করে
পাওয়ার বাসনা। আকুল হয়ে চাইলে তোমার কাছে আসবে। একজন বাচ্চাকে কুড়ি জন মায়ের কাছে ছেড়ে
দিলে সে ঠিক তার মাকে চিনে নিতে পারবে। বিজ্ঞানে তার ব্যাখ্যা নেই। তুমি যে ঘরে থাকো
যে খাটে শয়ন করো যে চেয়ার এ বসে লেখো সেটা ছাড়া অন্য জায়গায় সেরকম লিখতে পারবে না। কারণ একটা
ইকোলজিকাল ব্যালান্স তৈরী হয়।
রো : প্রশাসন বা সরকার থেকে কোনো সাহায্য?
সু : সরকারের কোনো সাহায্য পাওয়া যায়নি কোনোদিন। আমি
নিজেকে এমন একটা স্তরে নিয়ে যাবো যে গিয়ে আমি ভিক্ষে করেকরে সরকারের কাছে চাইবি সেই
মনোবৃত্তি আমার নেই। তার কারণ সরকারের টাকা যদি আমি নেই সরকারের লোক এর ওপর লাঠি ঘোরাবে।
তারা কি আমার মতো এই জিনিসগুলোকে ভালোবাসবে? একদমই না। এর মূল্যায়ন ভালোবাসার মূল্যায়ন।
এই জিনিস গুলো যারা যখন বানিয়েছেন কত ভাবনাচিন্তা করে বানিয়েছেন। সেগুলো কেউ চিন্তা
করবে না.. এটা অনেক পুরোনো জিনিস এই দেখ অমুক সালের.. ব্যাস শেষ হয়ে গেলো। কিন্তু এটা ডেভেলপমেন্ট। একটা কেরোসিন তেলের আলো প্রথম তৈরী হলো তারপর আস্তে
আস্তে তার পরিবর্তন হলো। দেখা গেল তখন ফ্লো অফ দি এয়ার, কংসাম্পশন অফ ফুয়েল এই
সব চিন্তা করে বানানো হয়েছে। এই যে কেরোসিন
তেলের লোমফের উপর যে ছ্যাদা সেগুলো কিসের জন্য? যাতে ফ্লো অফ দি এয়ার ঠিক থাকে,
ইন এন্ড আউট।
রো : বাইরের কোনো আর্ট কালেক্টর বা আর্ট ডিলারের প্রস্তাব?
সু : ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট বেশ কিছু জিনিস আমার থেকে
নিয়েছে। ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ সাইন্স মিউসিয়ামও। অফারও পেয়েছি অনেক। কিন্তু
আমি দেইনি। পয়সা পেলাম আর অনেক কষ্ট করে জমানো জিনিস গুলো বেঁচে দিলাম সেগুলো আমার
কাছে আত্মমর্যাদাকে বিক্রি করে দেওয়ার সমান। এরাই আমার মর্যাদা। এরাই আমার ডিগ্রী। ডিগ্রী যদি ফেলে দেই
সেই টাকা নিয়ে আমি কি করবো? অতীতের তুলনায় এখন জীবন অনেক সস্তা হয়ে গাছে আগে একটা মূল্যায়ন
ছিল।
রো : রক্ষনাবেক্ষন কি সব নিজেই করেন?
সু : সব। সব একলা করি... সবটা
রো : আপনার পরবর্তীতে এই সংগ্রহের কি হবে?
সু : এরা ভালোবেসে এসেছে আমার কাছে আবার ভালোবেসে যার কাছে যাওয়ার যাবে।কেউ ভালোবেসে যদি ধরে নেয় থাকবে।
রো : আগামী প্রজন্মের কি কেউ এতে আগ্রহী?
সু : তারা আসে খুব আগ্রহ নিয়ে, কিছু জানল, কিছু কথাবার্তা রেকর্ডিং করল। কিন্তু তাদের আর ফিরে পাওয়া যায় না। অবশ্য এজন্য আমি তাদের একবারও দোষ দিই না। তারা দোষী নয়। তাদের এইভাবে তৈরী করা হচ্ছে। এই তৈরী করাটা কাদের হাতে? এটা তাদেরই হাতে যারা অ্যাডমিনিস্ট্রেশনটা চালাচ্ছে। অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে এদের সঠিক পথে পরিচালনা করতে হবে। দরকার পড়লে অপোগণ্ড গুলোকে পিন আপ করে ঠ্যাঙাতে হবে। আমি তাদের শাস্তি দেওয়ার কথা বলছি না। আমি বলছি তাদের শোধন করতে হবে, তাদের উপলব্ধি করাতে হবে যে কাজটা তারা করছে সেটা ঠিক নয়, তাদের পরবর্তী প্রজন্ম কি শিখবে? তাদেরকে ভবিষ্যৎটা চিনিয়ে দিতে হবে।
![]() |
Yashica camera হাতে সুশীল বাবু |
Previous Issues (conversation):
No comments:
Post a Comment