ব্যক্তিগত গদ্য

দ্বিতীয় বর্ষ  প্রথম সংখ্যা 


তিনটি ব্যক্তিগত গদ্য




স্নেহা রজক দাস 

কাঁচ ভাঙার শব্দ শুনলে এখনও হঠাৎ চোখের কোণে জল আসে

কাঁপা কাঁপা স্বরে কেউ যেন জিজ্ঞেসা করে , " ক্লান্ত চোখে এখনও জল! কেন , কী কারণ শুনি!"

যতবার উত্তর দিতে যাই ততবার কে যেন অতি সচেতনতায় মনে করিয়ে দেয়সকল কথা বলতে নেই ....

জীবনের সব সত্য একবার ফিরে আসে ,

আমাদের সকল ব্যথা নক্ষত্র জানে

সুতরাং, নীরব থাকো!

 

--কোনো কথাই বলা হয়ে ওঠেনা আর

শুধু , স্তব্ধ বাতাসে ভেসে বেড়ায় পরীদের ফিরে যাওয়ার গন্ধ, বিকেলের আকাশে জলকণা' মতো জমাট বেঁধে থাকে

একরাশ মনখারাপ আর কান্না

কিন্তু কিসের এত মনখারাপ ?

উত্তর হিসেবে বারবার ফিরে আসে ভাঙা কাঁচের জানালা দিয়ে দেখা একটি' দৃশ্য --

কোন সুদূরে পথের শেষে কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছে একটি নিঃশব্দ ছায়া...

আর কোন এক অমোঘ মন্ত্রনায় কিছু শব্দের পাশে 'সম্ভব' কথাটি সরে গিয়ে অনায়াসে যুক্ত হচ্ছে 'অসম্ভব '!

 

যা কিছু অসম্ভব , যা কিছু চাইলেই

পাওয়া যায় না , তার' হাত ছঁুয়ে থাকেঅপেক্ষা ফু রিয়েও যায় একদিন

সেদিন আর কিছুই আগের মত থাকে না দঃু খের উপত্যকায় ফু হয়ে ফু টে থাকে দু এক ফোঁটা কান্না, অসম্ভব আবেগ ;

জমা হয়

না বলা কথার মতো কয়েদি শব্দদের পাশে

অনায়াসে

কে যেন কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে যায়,

" যারা অপেক্ষায় থাকে তাদের চোখে জল আসে অল্পেতেই ..."

 

এত মায়া ছিল ?

তবে কেন বলতে পারিনি শেষবারের মতো,

"ভালোবাসি "?

নিবিড় করে জড়িয়ে থাকে আমার ভাবনায়

কেবল একটি' নাম...

পাশে উজ্জ্বল বর্ণে লেখা থাকে ,

" উত্তর আসবে না কিন্তু তু মি আসবে জানি"!

 

আমরা কোথাও আটকে পড়ি অপেক্ষা আর ভু লে থাকার মাঝে

তখন ক্রমশ স্পষ্ট হয় নিখুতঁ চিত্রের ন্যায়

অনুভূতি আর অনুজ্জ্বল একটি আলোর শিখা

দরূ থেকে ভেসে আসে প্রাচীন বিলাপ , " O foolish Phyche ! this is thus you repay my love ?",

ভাঙা কাঁচের জলনায় ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে....

প্রতিধ্বনিত হয় -

"O foolish Soul ! this is thus you repay my emotions?"

একফোঁটা চোখের জল নোনতা মাটি ছুঁয়ে 

অদৃশ্যে মিলিয়ে যায় যেন  দূরের রাস্তায়

ইতস্তত ছড়িয়ে থাকে কিছু ঝরা পালক আর

খুব চেনা একটি গন্ধ

 

আর কেউ ফিরে আসে না ....









জগন্নাথদেব মন্ডল


আজ পয়লা ফাল্গুন। গত পরশু থেকেই একটু একটু করে রোদ বদলে যাচ্ছে বুঝতে পারছি। এমন দিনগুলোয় বিশেষ করে দুপুরবেলার দিকে মন উদাস হয়ে যায়। কেমন একটা অনেকদিনের হাওয়া এসে গায়ে লাগে। আকাশ নীলাভ ও ছমছমে। এক ধরনের সব কাজ পণ্ড করা বিষাদ শুধু ঘুমের দিকে ঠেলে দেয়। অনন্ত ঘুম। 

কিন্তু আমি ঘুমিয়ে পড়ি না। ধনেপাতাফুলে মৌমাছিদের ওড়া দেখি। ঝিম গন্ধ। সুন্দরী গাছের কথা ভাবি। সারা জীবন ধরে আমি যেন আমার ওই মানুষটির পিপাসার সময় জল তুলে দিতে পারি মুখে। শীতলজল। মিষ্টি কুয়োর পানি। 

সুন্দরবনের সাতজেলিয়ার যে পাঠশালা সেখানকার ছোট ছোট বাচ্চাদের কথা মনে পড়ছে। পড়তে পড়তে ওদের খিদে পেল, আমি বিস্কুট ভেঙে খাওয়ালাম। সহজপাঠ পড়াচ্ছিলাম। স্বরবর্ণ চেনাচ্ছিলাম। ওরা কচি কচি ছোট ছোট নিবিড় হাত আমার হাতে রেখে স্যার স্যার বলে ডাকছিল। বাঘের গল্প বলছিল, শীত ও লোনা জোয়ারের। 

এ সপ্তাহে যাই নি। কিন্তু ছেলেমেয়ের দল আমার দেওয়া সমস্ত পড়া ও লেখা তৈরি করে রেখেছে। আমার জন্য অপেক্ষা করছে। দোস্ত ভিডিও কল করে দেখাচ্ছিল যে, কচি কচি মুখগুলো হাত নাড়ছে আমার দিকে তাকিয়ে। ছেলেমেয়েরা আমি আবার তোদের কাছে যাবো রে...

রঘুনাথপুরের পিচরাস্তায় একজন মেয়ে মাস্ক ঢেকে মুখে প্রেমিককে চেনে না এমন ভান করে টুক করে প্রেমিকের মোটরবাইকে উঠে হাওয়া কেটে দিগন্তের দিকে চলে গেল। আমি রোগা লোক, কথায় কথায় কেঁদে ফেলা লোক, নরম মাধুকরী করা লোক, ছাগলছানাকে ঘাস আর হাঁসেদের মুড়ি খাওয়াই নিয়মিত; সেই পূণ্যে বলি--তোমাদের ভালো হোক। 

বিষাদ, অভিমান, মনখারাপ, কান্না এখন যাও। এখন শুদ্ধ বিকেল। এখন আমি পানদোকানে এসেছি। মেয়েলি হাতের ভালোবাসায় দেখছি কীভাবে সেজে উঠছি। মিঠেপাতি চুন জর্দা খয়ের সুপারি মৌরিফুলের  ঘ্রাণে।

দোকানের চটা আয়নায় দেখছি নিজের মুখ, হাওয়ায় নিজের বসন্ত ক্ষতের রঙীন মুখ দেখতে পেয়ে ঠিক সন্ধের আগে আমি হেসে ফেলছি খিলখিল করে...





শেষ বৈশাখ

 শুভজিৎসরকার

 

বাঙালি চলতি হাওয়ার পন্থী, তাকে ক্যালেন্ডারের দুয়ো দেখাতে যাওয়া অর্বাচীনের কাজ তাই বৈশাখ মানেই অলওয়েজ পঁচিশ এর বাইরে আমাদের বাংলা তারিখ মনে রাখার কোনো হুলিয়াই নেই, এই সবই আবার মনে রাখার সংস্কৃতি দেখানোর তাগিদে তাই আমিও বচ্ছরকার প্রথম দিন পয়লা না পহেলা লিখব বলে দ্বন্দ্বে পড়ি নত্ব-সত্ব না জানা লোকেদের এসব হয়.. মুগ্ধবোধ পড়িনি তাই মনে যা আসে তাই লিখে দিই কিন্তু আরেকটা নতুন নববর্ষের ঠিক আগে আগেই যখন এই লেখা লিখছি, তখন নববর্ষ মনে আমার একটা গোটা দিনকেই মনে হয়, যা সেই চৈত্রের শেষ বিকেল থেকে শুরু হয় আর বৈশাখের প্রথম দিনেই শেষ

 

 

শুধু কি তাই? এতটুকুতেই শেষ? হালের বাঙালির এক সপ্তাহের নিউ ইয়ার ইভ, এক পক্ষকালের দুর্গাপুজো ছেড়ে জাস্ট একদিন বছর বরণ, তাই কি হওয়ার কথা ছিল? তাই হয় তবে আমার মতো যাদের কোনো দিনই স্পেশাল নয়, এমন মানুষদের পয়লা বৈশাখ একটু অন্যরকম ছেলেবেলায় এই দিন বলতে শুধু বুঝতাম নতুন জামা আর সন্ধ্যায় কিছু মিষ্টির প্যাকেট সকালে এই সব দিনে স্কুল থাকতে নেই আর টিউশন থেকে বাগিয়ে আনা বিকেলবেলার  ছুটি, ঘুম থেকে উঠতে নির্ঘাত দশটা মা এই সব দিন আমার শৈশবের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়নি, তবে ঘুম থেকে উঠেই আমাদের এক টুকরো ছোট্ট ঘর জানান দিত আজ বচ্ছরকার প্রথম দিন সারা ঘর বেলফুলের গন্ধতে ভরে আছে, সকালে মায়ের ঘরে পুজো দেওয়া ফলের টুকরো গুলো দেখছি ছোট্ট রেকাবিতে ঢাকা এরপর মা আলতো করে ধমক দেবে, আমিও চোখ পুছতে পুছতে ঘুম কাটিয়ে গন্ধ নেবো বেল ফুলের গন্ধময় ঘরের প্রথম দিনেই একটু পরেই মা অঙ্ক করতে বলবে, আমি অঙ্ক বই খুলতে না খুলতেই টের পাচ্ছি গোটা ঘর আর বেল ফুলের গন্ধে ভরে নেই, পাশের এক ফালি বারান্দায় মা লুচি ভাজছে আমি এইবারই বুঝতে পারি আজ স্পেশাল কিছু তাই যেই অঙ্ক কোনোদিনই করিনি এমন অনুশীলন পৃষ্ঠা খুলে বসি, খাতায় সদ্য কেনা পেন দিয়ে তার আগে অন্তত দু চার খানা অঙ্ক তুলে ফেলছি যা আমার প্রায় এক জন্মের না জানা কঠিন কোনো জগদ্দল আমি অঙ্ক করার ভান করে যাই পাক্কা দশ মিনিট তারপর মা পড়াশুনোর বহর অঙ্ক খাতায় দূর থেকে চোখ বুলিয়ে ভাবে , অনেক হয়েছে তাই আমিও ছাড়পত্র পাই লুচি আর সাদা আলুর তরকারির, এবার বুঝতে পারি আর পাঁচটা দিনের থেকে সরে যাচ্ছে কোথাও তখনই পিছনে তাকালে দেখতে পাই , কয়েকটা দিন আগে আমি নিয়ে এসছি আমার আরেক কলোনী পাড়ার স্মৃতি যেখানে গোটা কতক গাজন সন্ন্যাসী  ঘুরে বেরিয়েছে পাড়ার জুড়ে ওদের ওই পোশাক দেখে কৌতূহল জাগলেও সব মিটেছিল  অদূরে এক চড়ক পার্বণে কলকাতার চরক আসলে কলকাতাতেই বিশেষ, এর বাইরে সবই যেন নিয়ম রক্ষার উপাচার ক্লাস থ্রি-ফোর এর অবুঝ মন কি এসব বোঝে ? তাই সে বায়না করে যাওয়ার  শোনা মাত্রই তার সব দেখা চাই ,চালতাবাগানের ঝুলন থেকে লাটুবাবু-বাজারের চড়কের ঝাঁপ

 

 

আবার যে মন দুই দিন আগে গাজনের ঝাঁপ দেখে ফিরলো, তাকেই আবার শেষ বেলায় শহরতলির চৈত্রসেল দেখতে হবে শৈশবে মায়ের সাথে বাজার করার এই চৈত্র আঁচ নিয়েছি ছেলেবয়েসে বাবা এসব সেলের পথে ঢোকেন না তাই , নিম্ন মধ্যবিত্তের সংসার কে যেন নতুন বছরে আরেকটু নতুন করতে চান মা চৈত্র সেলে জামা জুতো নয় ঘরের ছোটো ছোটো জিনিস কেনেন মা ওটুকু বয়েসেই আশ্চর্য্য হয়ে তাকিয়ে দেখি সব প্রায় তিন ঘন্টা ঘুরলে শেষ হতো আমাদের কেনাকাটি এর একদিন পরই হয়তো নতুন বছরের ভোর.. এই সবই মনে আসে আমার শৈশব নববর্ষের  স্মৃতি এতো কিছুর পরও মনে পড়ে, এইসব মার্চ এপ্রিলের গরম কোনো ঝক্কি আনিনি ওটুকু বয়েস তখন  দিব্যি জানান দিত, হাতে গোনা আর কটা দিন পরেই গরমের ছুটি তাই এও যেন আমার নববর্ষের পরিপূরক যার শুরু হতো এই বছর পয়লার দিন থেকেই

 

 

 

আমাদের যাদের ছোটবেলা এক পাড়া থেকে আন্য পাড়ায় কেটেছে, তাই তাদের ইমেজ ফ্রেমও বদলে গেছে বারবার  চড়কের সাথে নববর্ষের সম্পর্ক ওই বয়েসে আন্দাজের বাইরের কোর্টে ছিলো, বয়েস বাড়তে সেসবই যেন বসন্তের নিভে আসা শেষ বাড়ায় সেসব দিন কার হাত ধরে যেতাম, কে কিনে দিয়েছিল বিডন স্ট্রিট থেকে প্রথম গ্যাস বেলুন, তারা কোথায় আজঠিক কত জন নেই আজ.. প্রশ্ন আসছে একটা আগাম নববর্ষের আগে সুমন বলেছেন, "যারা চলে গেছে তারা রয়ছে ,স্মৃতি প্রতিটির কোনো কক্ষে" এই নববর্ষ তাই আসুক তাদের আবার মেলে দিক.. তবু তো থাকবে কিছু শেষ চৈত্রের রোদ

 

 

তবে শেষ কত বছর চৈত্র সেলের ব্যাবসা জমেনি ছোট দোকান গুলোর, এসব আক্ষেপ এবারও শুনব হয়ত চড়কেরর 'টা  মেলা এখন কলকাতায় হয়? এসবই এখন ঘুরে ফিরে ভাসে এটাই হয়তো বয়স বাড়ার নতুন কোর্ট তাই সব কিছু দেখতে দেখতে যাই তবুও চাই , চৈত্র শেষের আগেই যেন আমাদের বাড়িতে একটা নতুন বাংলা ক্যালেন্ডার ঢোকে , যাতে এই বার থেকে যেন আমাদের সাব কনশান মাইন্ড একটা নতুন বৈশাখের খোঁজ রাখতে পারে সচেতন ভাবে যেন একটা নতুন বৈশাখ আসে, যেখানে আমার মত নাদান বাঙালিরাও স্মৃতি অ্যালবাম ঘাটতে ঘাটতে বাংলা নববর্ষকে দুয়ো থেকে সুয়ো রানি করুক ,তবেই তো ফেলে আসা বৈশাখ গুলোর সাথে আরেকবার চিয়ার্স করা যাবে

 

 

 





প্রথম বর্ষ  পঞ্চম সংখ্যা





প্রয়াণকথা

শতানীক রায়


গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুটো চিত্রকর্ম দেখছি দু-দিন ধরে। আজ সন্ধ্যায় সেগুলো ভীষণ উতলা করছে আমাকে। প্রথম চিত্রটি এরকম— চৈতন্যদেব সমুদ্রের ধারে বালির ওপর বসে আছেন। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে কী ভাবছেন জানি না। চিত্রের নাম অনুযায়ী তিনি সমুদ্রের বাজনা শুনছেন। কোথাও আমি দেখতে গিয়ে সংযুক্ত হচ্ছি আবার কিছু পরেই বিচ্ছিন্ন। কোনো নির্দিষ্ট আকৃতি নেই। আমি হয়তো নেই। আমিই আবার আছি। নীলশান্ত সমুদ্র। সংগীত নীল। চিত্রের ওপর দিয়ে মাখনের স্তর পড়ছে। সমুদ্র কোথাও থেমে গিয়ে চিত্র আনছে। শিল্পী মিশেছেন বা তাঁর মৃত্যু হয়েছে। সমুদ্রের শব্দ কল্পনা করতে গিয়ে আমি রং অনুভব করছি। পরাভব। বিচ্ছিন্ন জ্যোতি। চিহ্নও। আকৃতি। আকৃতির বিচ্ছেদ। আর শুধুই দুধ সাদা প্রবণতা। আমার অতীতদুধ হয়েছে। নীল তাহলে এক পরাতৃপ্তি। শুনে যাওয়ার দীর্ঘ জিজ্ঞাসা। জিজ্ঞাসা বিচ্ছেদ। আমাকে কোথায় গিয়ে জেনে নিতে হবেঠিক কোথায় যাবএক বিপুল পরাভব। একের পর এক থেমে যাওয়া। তির। বিদ্ধ হয়নি এখনও। বিদ্ধ হওয়ার অপেক্ষা আছে। অপেক্ষা থেকে ঢেউগুলি থেমে চিত্রে এসেছে। আমাকে এখন এই মুহূর্তে কী করতে হবেকীভাবে চিত্রে অর্থ আর গতি দুটোই ফিরে পেতে হবেজিজ্ঞাসা আছেতার নিরসন নেই।

      পরের চিত্রটি— চৈতন্যদেব নির্বাণ নিয়েছেন। সমুদ্র-সমুদ্র। শুধু রং। অতীত নেই। এক বিপুল স্রোত। আমাকে যুক্ত হতে হয়েছে। আহ্বান এসেছে। গতি ভুলে গিয়ে। অন্য এক বিপুল। প্রবলেরও এখানে অন্য অর্থ। আমি বিস্মৃত। পথিক ছিলাম। এখন সওয়ারি। অনেকদিন। একভাবে বয়ে নিয়ে চলেছি। বয়ে নিয়ে চলেছে। এরকমও হতে পারে এখান থেকে কোনো অর্থের শুরু। এত বড়ো জগৎ। তুমি আর আমি কেউ নেই। চিহ্নমাত্র। শব্দমাত্র। এর অধিক আমি ভাবতে পারি। থেমে। আগের দৃশ্যের কোনো কিছু নিঃশেষ নেই। ভাষার জন্মই হইনি। আমি আছি। সমুদ্র আছে। ভেসে যাওয়ার অবয়ব আছে। যতক্ষণ আমি দেখছি। অবয়ব যেটুকু মৃতের ভেতর ধরে রাখতে পারি। অথবা আগের যা কিছু দিয়ে আমি তৈরি। সে-সব নেই। এই মুহূর্তে মিশে গিয়ে আছি।   

 

নির্দিষ্ট কিছু না। গাছ থেকে ফল পড়ল। একটি জীবন থেকে আর একটি জীবনের জন্ম। আমি এই গদ্যের ভেতর বাহু প্রসারিত করতে চাইছি। প্রসারিত-বাহু আমাকে কীরকম দেখতে লাগে। আমার কিছু একটা বলতে চাওয়া। বলার আগে কত কিছু ভেবে নেওয়া। দুপুর খুব শান্ত। বিকেল আরও। সন্ধ্যার পরের পৃথিবী অদ্ভুত। আমি তাকিয়ে থাকি অনুভব করি কত কত মানুষের শূন্যতা প্রবাহিত হচ্ছে। আমি একটি সন্ধ্যায় যেমন আজই ভরে উঠতে চেয়ে আকাঙ্ক্ষিত হলাম। তারপর কত আখ্যান সৃষ্টি হল। গল্পের ভেতর গল্প। আর গতকালের দুটো চিত্র এবং সেই চিত্রদুটোর মৃত্যু। আমি অনুভূতির রেশ পাচ্ছিগন্ধের স্মৃতিও আছে। ফুরিয়ে ওঠার রেশ। আমি অনেকদিন আগেই নিঃশেষ হয়েছি। আজ কেবল কঙ্কাল বহন করে চলেছি। গতকাল যে-মানুষটি আমাকে বললেনতোমাকে খুব স্নেহ করি আমি। ভালোবাসি। সেই মুহূর্তে ভেবেছি। আমি তখন কোন এক পাহাড়ের কল্পনা করছিলাম। আমি তখন মাংসফুলে জীবিত একজন। শুধু ভাবি দিনের পর দিন। আমার শহরের অস্তিত্ব খুঁজে পাই না আমি। নিজের বাড়ির খোঁজ করি। মায়ের খোঁজ করি। বাবার খোঁজ করি। বন্ধুর খোঁজ করি। জীবিতকে প্রশ্ন করার ইচ্ছে জাগে। যে-ইচ্ছে অনেক আগেই ফুরিয়ে গিয়েছে। তার নিশ্বাস ছাড়ছি আজ। এভাবে সব শান্ত নির্জন হওয়ার কথা বলতে গিয়ে থামি। যেন অতীতে কোনো কিছুই হয়নিএইমাত্র আমি জল ভেঙে উঠে পৃথিবী দেখছি। অথবা অনেকদিন ঘুমোইনি। কথা বলে গেছি। এই মুহূর্তে অনেক কিছু… কারণ অনেক হতে পারে… অনেক মৃত্যুর অনুভূতি নিয়ে এভাবে বেঁচে আছি… আর একটু পরেই লেখার টেবিল ছেড়ে উঠে যাব।

 

ঠিক যে-মুহূর্তে আমি শিখে যাব। এখন সব ঠিক আছেআমাদের জীবনের কোনো মুহূর্তে আমি থেমে নেই। সমুদ্রের ঢেউ উচ্ছ্বসিত হয়েছে। পুরোনো বাড়ির সামনে এগিয়ে গিয়ে থেমে থেকেছিসেরকম অতীত যেখানে মানুষ থেকেও তার নির্যাস সে খুব অল্প রেখে এসেছে। চলে এসছে দূরে। সমুদ্র নেই এখানে— এরও বেশ দূরত্ব আছে। আমি মনে করতে চাইছি যেএখন সময় বলে কিছুই নেই অথচ বিশ্বে এখন সময়েই সব গোছানো আছে। এগিয়ে এসেছি। কেউ পড়তে পারবে না। সমুদ্র নেইসময়ও নেই। না কি পৃথিবীর এই পবিত্র ঘাস এখানে হালকা নরম শোকতাপ রেখেছে বা রাখতে পেরেছে। খুব আলতো রকম ছুঁয়ে বলিদান দিয়েছে সব... কেক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত কে এ-সব কেউ পারেনি বলতে। ইতিহাস যবে মুহূর্তে চরম হয়ে উঠেছে। আমি ভুলেছি সব। উচ্ছ্বাস ও জন্মের ক্রমক্ষয় আর অশ্রু। টলটল করতে করতে এখানে শুয়ে থাকা মানুষ ভীষণ বড়ো। ক্ষয়ের দরজা ভীষণ। নির্জনতম এতদূর এসে সময়হীন। প্রশ্নের পর প্রশ্ন সাধি নিজেকে। কোথায় আমার ভুল। কোন সময়ে সময়কে হারিয়ে ফেলেছি আমি। আরঠিক এই মুহূর্তে আমাকে মনে করতে হয় বেঁচে থাকার কথা। একজন বেঁচে থাকে আজীবনআমি তার মৃত্যুর অপেক্ষা নিয়ে ভাবি। কতটা অবধি সে জল আর কতটা অবধি সে নয়! 

 

প্রতিটি স্বপ্ন ছিল উদ্‌বেগেরভয়াবহতার।

 

গভীর ঘুমের মধ্যে কেটে গেল রাত। বৃষ্টি হয়েছিল। 

তবু সে-ঘুম ভাঙেনি। 

 

শুয়ে থাকি। শুয়েই কাটিয়ে দিই ভোরবেলা। 

বুঝি দিনের স্বপ্নগুলি অত অর্থহীন না-ও হতে পারে।

                                              — উৎপলকুমার বসু 

 

আমি সমুদ্র দেখেছি। পাহাড়-পর্বতও দেখে এসেছি। সেই সময় পৃথিবীর ভেতর কেমন ছিল। একটা পৃথিবী ছিল ঠিকই আজ তারই অনুরণন চলছে। হয়তো তারই প্রতিফলন। কোনো মানুষ কিছু করতে পারছে না। প্রতিফলনে আরও প্রতিফলিত হওয়া ছাড়া। যে-মানুষটা সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে সমুদ্রের পুরুষ হয়ে কেবল হেঁটে যাবে বালি দিয়ে। সমুদ্রের বালি তার কখনো ফুরোয়নি। আমরা সেই মানুষের সাথে অনেক কথা বলেছি। অনেক আলো নিয়ে বেঁচে থেকেছি। মোহময় কিছু ছিল কি তখন! সমুদ্র দেখে এসেছিল সে। আজ বালির দানার মতো জীবন জেনে নিচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে ভেবে নিচ্ছে এখানে চিরকাল কেউ-না-কেউ এভাবেই হেঁটে সমুদ্রের সাথে সমান্তরাল হয়ে হেঁটে বেড়ায়। আমি তার ঘ্রাণ পেতে থাকি। কথা বলতে ভুলে যাই। দেখি হেঁটে চলার অমোঘ ইতিহাসে মানুষটাও কী অবিকল মানুষের মতো দেখতে।

 

বলতে ইচ্ছে করছে কিন্তু না বললেই-বা কী হবে! সব কিছু ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। সব কিছু ঠিক আছে। ট্রেনটা স্টেশন ছেড়ে চলে যাওয়ার পরমুহূর্ত একটাই। কত কিছু মনে হয়। আরেকটু দাঁড়াতে পারত আমি ট্রেনে উঠে যেতাম। ট্রেন থেকে নেমেছিতাতে কি ভুল হল কিছুএই দু-রকম ব্যাপার। বর্তমান অবস্থা জেনেও স্বীকার করতে না-পারার মধ্যে যেভাবে ভাষা অবলুপ্ত হচ্ছে যেভাবে পৃথিবীর ভাষার কাছে পৌঁছে গিয়ে আমি ফিরে আসছি। ভাষার করুণা। সবচেয়ে বেশি এই মুহূর্তে ভাষা ধরা দিচ্ছে। যেভাবে স্মৃতির কাছে আশ্রয় চেয়েও তোমাকে স্মৃতি পরিত্যাগ করে। দূরে সরে যায় শরীর। শরীরকে ভরসা করা যায় না। সে অন্য কথা বলেক্রমাগত অর্থহীন করে তোলে নিজের উপস্থিতিকেই। সেই কোন্ চিরন্তন থেকে ভেসে আসা কথা। হয়তো আওয়াজ। বা আস্ত ট্রেন— প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যাওয়ার পরও অনুভব করাতে পারছে নিজের উপস্থিতি। কিংবা সবই অনুপস্থিতি। তার থেকে অতিক্রম। অথবা মৃত্যু। 

এভাবেই দিন অতিক্রম করি মাস পেরোতে থাকি— মাসের পর মাস বছর শুরু হয় আর সব মিলিয়ে যেতে থাকে। আমরা অনন্ত পথের সওয়ারি। ভাষা ধরতে পারি না। শূন্যে গুটিয়ে আসে ভাষা। ভাষাহীনতা। একটি রোগ। আমার শরীর এতগুলো বছর অতিক্রম করেও ভাষাটা রপ্ত করতে পারল না। একটা খাঁজ যার ভেতর বসে থেকে আমি দু-দণ্ড ভেবে নিচ্ছি আমি কীরকমভাবে বেঁচে আছি। কিছুক্ষণ আগে সন্ধ্যে অন্য রকম কাটল। এখন এভাবে লিখতে বসে সন্ধ্যার অনুভূতি লিখতে পারব না আমি। দিনরাত। সূর্য অস্ত যাওয়া আর উদয় হওয়া। এর কি কোন কারণ খুঁজে বের করতে পারবআজ থেকে অনেকদিন আগেই ফুরিয়ে গেছি আমি। ফুরিয়ে গিয়ে ফাঁকা হয়ে বেড়াচ্ছি। তুমি একটি শূন্য কল্পনা করতে পারো। আমার কোনো নামও নেই। আমার সঠিক নাম কেউ দিতে পারেনি। আমি প্রশ্ন করছি সেইসব মানুষদের যারা আমাকে আমার নামে ডেকেছিল। আসলে তাদের চিহ্নিত নামে। ডাকার আনন্দে কি আমাকে ডেকেছিলআজও কি আমাকে কেউ ডাকার আনন্দে ডাকে! 

সুন্দর ও গোছানো। এখন এ-দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। একইভাবে ভাবছি। গতকালও একই কথা। ঘুমের মধ্যে কত কিছু ঘটে। কোথা থেকে কীসের শূন্যতা তার প্রকাশ করতে ভুল করি। কারণ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকি। ঠিকরে বেরিয়ে এলাম। কোন ঘরে ছিলাম টের পাইনি। যে-হারমোনিয়াম বাজাতাম সেটা এখনও আছে। ঘরের এক কোণে। আমি কি এভাবে ধাপে ধাপে কোনো দ্বীপে পৌঁছে যাবপৌঁছে গিয়ে অনুসন্ধান করব ভাষারশূন্যও খুঁজব?! একের পর এক দিনগুলো বেঁচে থেকেছি। সিঁড়ি তৈরি হল। তারপর বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে আলোকিত কোনো জগতে… কী অদ্ভুত ধু ধু বালির বোধের মধ্যে যেরকম। তুমি এইসব মিলিয়ে অনন্তের চিন্তা করতে পারো। অনন্তকে মিশিয়ে দিতে পারো খুব তীব্র। ভাষা যে আমি খুঁজে পাইনি। ভুলবশত অন্য দেশে এসে পড়েছি। আমি এখন একটি হারমোনিয়ামের বেশে দিব্যি আছি। ঘরের এক কোণে। সময় কীভাবে যেন প্রবাহিত হচ্ছে। একটি আয়নার ভেতরআমি যে এখন একটি হারমোনিয়াম যার শরীর ছাড়া কোনো স্মৃতি নেই। রেখা নেই। ভাষা নেই। 

 

গতকাল যে-অপরিসীমের কথা লিখেছিলাম সেরকম কিছুই নেই আজ। আমি অনেকদিন পড়ে আছি। মাঝে মাঝে মাথা তুলে দেখি। নতুন ঘাসের জন্ম হলে আনন্দে থাকি। আর ভালো করে ভেবে— এ-সব আনন্দের কোনো শব্দ হয় না। যেদিন ঘুমিয়ে খুব ক্লান্ত হই কাতর হয়ে পড়ি দেখিসূর্যোদয় হচ্ছে আজও আর আমাকে এই ভোরের মহিমা টিকিয়ে রাখতে হবে উচ্চারণে অথবা অন্য কোনোভাবে... 

 

প্রথম থেকে শুরু হয়েছিল। বুঝতে পারিনি। খুলে যেত একটু পর পর... বাক্যগুলো খুলে যেতে বসেছে। খুলে শেষ হয়ে যেতে পারে। অন্তিম সময় যখন লক্ষ করছিঅল্প ঝুলে আছেপাহাড়ের অনেক ধারে ঝুলে আছে। ঘাস ছুঁয়ে বাক্যটাকে গুছিয়ে এনে পুরে রাখলাম। আর সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করল শব্দগুলো আর প্রতিটা শব্দ তখন আলাদা আলাদা পৃথক নদীর শক্তি ধারণ করে স্রোতস্বিনী।...

 

অবশেষে কোনো সূত্র না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। পৃথিবী সূর্য চাঁদ নক্ষত্র গ্রহ-উপগ্রহ নিজের মতো অবস্থান করে। যে-বাড়িতে থাকি সেটাও নিজের ধর্মমতো চলে। মানুষগুলো জীবিত থাকে। গভীর রাতে কাক আওয়াজ তুলে ক্ষান্ত হয়। অনেক দূর পর্যন্ত সূর্যরশ্মি আছড়ে পড়ে। জঙ্গলে জঙ্গলে অন্ধকার মেশানো সবুজ রং মৃত হয়ে থাকে। নদীজল শান্ত বয়ে চলে। আর এ-সবের ভেতর আমি বেঁচে থাকি। বেঁচে থাকার ভেতর উঁকি দিয়ে দেখি। তল-অতলের মাঝির সন্ধান করি। আর গান গাই।

 




 

 

ব্যক্তিগত দিনলিপি 

মানস ব্যানার্জী



(1)

শহরের বর্ণনা দিয়ে আমার কোনও লাভ নেই। ইচ্ছা নেই এক একদিন যদি দেখি ধর্মতলা দিয়ে চলে যায় ট্রাম রাত বিরেতে একা একা  ঘটাং ঘট। ঘুমন্ত মানুষের মুখ তখন কল্পনায় ভাসমান সমুদ্র। কে জানে আজ বাদে কাল মৃত্যুঞ্জয় খঞ্জনি বাজাবে। এক'শ দু'শ দিন ধরে মানুষের ঘুম এক অসীম সাহসে টানেলে প্রবেশ করেছে কোন অন্ধকার গতিবেগের সম্মুখীন কোথায় কোথায় আরও দূরত্ব আরও সুখ আরও আরও ট্যালকম পাউডার আর রোদ্দুর আর অসাবধানী চাঁদ নিয়ে চলে যায় গুপ্ত অভিসার।

 

(2)

রঞ্জনদা তোমাকে জানাবে এবছর আরও কতগুলো দিন এবং রাত নির্বাসনে কাটাবে মানিব্যাগ। তারপর হইচই ছোটাছুটি চাল আর সরকার পরিবর্তন। কিলোতে নুন তার ওপর গুণ নিত্য মানুষের অভাবের সংসার। রাজহাঁস পুকুরে দুপুরময় সন্ন্যাস সন্ন্যাস খেলছে যে শিশুটি তার গল্পের অধিকারে কাছে আসে। তাকে আমি ঘুম পাড়াই। ওই রাজহাঁস ও তার পালকের অভাবী বর্ণনা কে বলবে এও এক সত্যিসফেদ খেদোক্তি ...

 

(3)

আমাকে কঠিন গদ্য এখন রোজ জাগিয়ে দেয় দেওয়াল ধরে ধরে সব শব্দের অর্থ কিছু কিছু জনান্তিকে জানানো। কেন মানুষেরা একত্রিত নয়। কেন তাদের ছ্যাঁক্ ছ্যাঁক্ কড়াইএর ধার ঘেঁষে নতুন আমার হাসি কেবলই কিছু অর্থ বহন করে। কেবলই চিঠিপত্র দেয়। অভ্যাস করে এক দিক্বিদিক সমাজের উত্তর কলকাতা তোমার গলির পরিচয়।

কেমন যেন পায়রা পায়রা বকবকুম বকবকুম দুপুরবেলা আর ভ্রমণ চলে যায় নাভির চারপাশে যেন ছেঁকে আছে দরিয়ার ঘড়িয়াল।

 

(4)

দয়াল মাঝি আমাকে ফেলে চলে যাওয়া সূর্যের গল্প বলে । বলে ছায়ার কথা। বনের কথা। আর তারাসুন্দরীর কথা। এক ছমছমে রাত তার নৃত্যের কথা। কেবলই বিজলি বাতি । নিভে যাওয়া পাড়ার মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া সাইরেন । বেঁচে থাকা অর্থহীন । জরুরি কর্তব্য বলে মাংসের দোকান । তার পাশে চায়ের দোকান। আরও আরও বাস চলে যাচ্ছে গড়িয়াহাটের দিকে। শ্যামবাজার অবরুদ্ধ তিনমাস নেতাজি লেজের দিকে শুনসান ফু দিয়েছে একা একা গল্পবলা পাখি। ছাদ থেকে দেখতে পাওয়া মহিষবাথান। তোমাকে উল্টোডাঙায় পেয়েছে। এখানে রথ চলেছে শৌর্যের খাতিরে। মেট্রোর উদ্বোধন নতুন নতুন সওয়ারি জ্ঞান বিজ্ঞান।

 

 

(5)

হরিণগুলো সব জল খেতে খেতে মৃত্যু চিন্তা অবাক চিৎকার। সাদাবাঘ তার শীতল দৃশ্যের পাশাপাশি এই মুহুর্ত তার পর গুলো থেমে থাকা যাবে না। পেরিয়ে যাবে গ্রাম । ছুটন্ত বাঁশবন। খেত নদী কলার সহস্র এক বাগান পেরিয়ে যেন এই এইমাত্র এসে পৌছালাম এই ছাদের তীর্থক্ষেত্রে। চারিদিকে অজস্র বাড়ি। তাদের মাথা । মাথার ভেতর হলুদগুঁড়ো গুঁড়ো ফুলের ভালবাসাময় রেণুর গুপ্ত চিহ্ন। যা সব মানুষ তার গল্পের ভেতর বেশ বুদ্ধি লেগে আছে। আর ভগবান। তার শত সহস্র ভাইবোন।

 

তুমি চিনে বাদাম খেতে পার। আর শঙ্খধ্বনি। তারপর যুদ্ধ । ডাক্তার। উকিল। পুলিশ। লেঠেল বাহিনী। তারপর ধড়াচূড়া পরা অমোঘ মিশোরবাহিনী আমি তাদের গল্পে দেখেছি ছেলেবেলায়। দুটাকা তিনটাকা। সেসব আজ আর পাওয়া যায় না। মোহন অধ্যায়। মা মানুষেরা আজ ভীষণ জ্বরের ভেতর কতগুলো মুখ খুঁজে বের হয়। হয়রান হয়। আর রোজ ভুল বকে। রোজ রোজ মনখারাপ ।

 






লকডাউন-৪ জীবন-৫

দেবার্ঘ্য দাস

 

লকডাউনের  পরে,-

রাজধানীর আবহাওয়ার মতোই এখানকার বেশীরভাগ মানুষের মনেও দূষণ!  চিন্তার ফারাকমানসিকতার ফারাক। যেখানে কয়েক মিনিটে দুমদাম গুলি চালিয়ে দেওয়া যায়যেখানে সবাই 'শের'!,  সেখানে আমরা নিতান্তই পিপীলিকালকডাউনের হ্যাঙ্গওভার বাহ্যিকভাবে কেটে গেলেও মাথার ভিতরে এখনও ইন্দ্রপ্রস্থ নয়ডা এক্সপ্রেসওয়ে এর ছবিগুলো ভেসে আসে। ভালোবাসাভালোথাকা গুলোকে কিরম যেন ঘৃণিত ছোঁয়াচ মনে হচ্ছিলপ্রথমবার প্রিভিলেজ হওয়ার অভিশাপ কাকে বলে দেখতে পাচ্ছি। ওয়ার্ক ফ্রম হোম এর খাঁচায় বসে দুনিয়ার সবাইকে বাঁচিয়ে রাখামেরে ফেলার হিসেব নিকেশ পার করে ভুলতে বসা কবে ঘুমিয়েছি!

 

ফিরে দেখা ফ্রেম হিসেবে নয় যতই বেঁচে থাকার যাপনে এগিয়ে যাওয়াই নিয়মসেখানে ফ্ল্যাশব্যাক বা সিনেমার ভাষায় 'কাট'- ভালো খাপ খায়। দিনের বেলা হোক বা বিকেল বোঝার উপায় নেই যে কয়েকদিন আগে অবধি এখানে শুধু মানুষ নয়গোরু ছাগলের ঠেলায় রাস্তায় হাঁটা দুর্বিষহ হতো। কিন্তু এখন যেন পুরোটাই স্বচ্ছধুলোর আস্তরণ কিছু আছে যা বাতাসে রয়েছে লেপ্টেহতাশা আর ভয়ের ক্যানভাস যেন এরকমই ভয়ানক একঘেয়েমিকর। একদিকে বিশালসংখ্যক মানুষের লড়াই হতাশা জেদ আশা জড়ো হচ্ছে রাজপথেবাড়ির টান বড়ো মায়ার টান! গুলিয়ে যাচ্ছে আমরা ওরাগুলিয়ে যাচ্ছে গ্রেসফুল কার জন্য থাকতে হবে - এই বেঁচে থাকার ধরনের যেখানে বেঁচে থাকাটা স্রেফ চলমান সময়ের একটুকরো দৃশ্যপটপ্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে ফেলার বাসনার চিরন্তন বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মধ্যবিত্ত সুরক্ষিত বলয়- 'যাই হোকআমি তো বাঁচি আগে'।  সময়ের ধারাপাতে আশীর্বাদ হয়ে আসে দূরত্বের কিলোমিটার। দূরে থাকলেই ভালো থাকা যাবেস্পর্শে রয়েছে হারিয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। এই ব্যবধানেই মন সান্ত্বনা পায় নিরুদ্দেশ না হওয়ার জন্য। তারপরে হাওয়া আসেখবর ফেরি করে - আলো নিভিয়ে দিলে ভ্যানিশ হয়ে যাবে মহামারিসমগ্র দেশে কুসংস্কারের অশ্লীল প্র‍্যাকটিস হলো অথচ মানুষের পেটে খাবার নেইনেই মাথার ওপর ছাদ। ছয় গজের দূরত্ব আর সাফ-সুতরো হাত যেন অলীক রূপকথা। দিন পেরিয়ে গেল এখানেওকিছু হাত কিছু মানুষের চেষ্টার টুকরো টুকরো প্রচেষ্টা নিবিড় করেছিল বিকেলের মেঘকে।

 

শহর সাক্ষী থাকে সবকিছুরসময়ের গতিপথ থেকে পাল্টে যাওয়া মানুষগুলো সবকিছু মিশে থাকে শহরের গায়েএকটা পুরনো গন্ধ টিকে যাবার চেষ্টা করে তাও লেপ্টে থাকে এই শহরেই। কিন্তু সেই হাহাকার আর রাজপথে পড়ে থাকা নিথর শরীরগুলো দিনের পর দিন এসে দরখাস্ত করেছে আর আমি এড়িয়ে গিয়েছি এড়িয়ে যাবার জন্যেই। যেন সেটি আমার একমাত্র ভবিতব্য!  আমার একমাত্র করণীয়!  সামর্থ অনুযায়ী বিভিন্ন একাউন্টে পরিমান মতো যাহোক কিছু পাঠিয়ে দিয়েই মিলেছে ছুটি। 

তারপরে কেটে গেছে অনেকটা দিনরাতমাস। অভ্যাসের চাদর গায়ে মেখে বুঝে নিয়েছি কীভাবে বেঁচে থাকতে হয়আর বেঁচে থাকার লৌকিক -পরলৌকিক ব্যবধান কাটিয়ে উনুনের আঁচে সাজিয়েছি নিজেকে আরেকবার। আর আকাশ বাতাস ভর্তি টাটকা বাতাস বুকে নিয়ে প্রমাণ করেছি জীবন উৎসবের মাহাত্ম্য আসলে পাশ কাটিয়ে দেওয়ার মধ্যে থেকে যায়।

 

মেঘ জমেছে আবার আকাশে

বৃষ্টি নামতে পারে শহরে

একটা ডাক তোমাকে আমাকে

বৃষ্টি নেমেছে শহরে। ভুলতে পারা যাবে মেঘলা যাপন

কোন ভিড়ে অসুখের সমাগম?

সন্ধে নামছে আমার শহরে

বৃষ্টি হচ্ছে শহরে। ছুটিরাও আজ নিয়েছে ছুটি

পাহাড় বিষাদময়;

এখানে আমরা দূরে দূরে থাকি

কাছে যাবার ভয়।

রাজপথে রূপকথা সাজে

জোড়া পা আর রক্তের উল্লাসে

ঠিকানার চিহ্ন নেই!

বৃষ্টি নেমেছে শহরে। এলোচুলে ডায়াল নম্বর

জানা কথাই শোনায় রিংটোন,

বৃষ্টি চলবে রাতভোর

একলা ঘর নিধুবন।

ভুলতে ভুলতে হাসির খোরাক

বাঁচার শেষে আধ খাওয়া পেগ

আমাদের ফান্ডামেন্টাল টু শ্লোগান মিছিল

বৃষ্টি আসুক বছরভর।

ব্যালট বক্সে বিচ্ছেদি টিপ

আমাদের সামাজিক বিপর্যয়

বেঁচে থাকে করোটির জমায়েতে। সব ভাসাতে বৃষ্টি নেমেছে।

 





 Home  

 Patrali Pradhan


What is home? Answering this question was way easier back in school. But as life unfolds, we start approaching things from multiple perspectives and all the cloistered definitions that had been imposed on us start to dismantle one by one. To some, home is a happy bubble where you are snug, unperturbed from the larger dilemmas outside. At times, life strands you at such crossroads that you question everything about your so-called conception of “home”; this epiphany befuddles you so much so that, you feel like switching on to “flight” mode; and yet you stay because home is the core of your being, the solace to your tattered soul irrespective of your conflicts with it. Sometimes home is right here, next to you; sometimes home is a stranger; and at times you find your home amidst aliens after you have traversed miles away from your erstwhile conception of home.

Home is my secure habitat, but it never shies away from hurling me into uncomfortable arenas even though they are my biggest fears. Home can a place or a being or just an emotion which I hold dear. Home is a two-way process, a give and a take; a hell of a ride making up our entire world. Home could be the consequence of antithetical forces at play; we don’t always break at the juncture between challenges and criticism, sometimes we outgrow us too; home could be both the pain and the cure. I have found my home in innumerable instances. Home could be as concrete as a person or a place; it could be as abstract as your imagination. Home is where you feel wanted but that does not imply that it will hesitate to criticize you. Home is not a set belief of good or comfort; it is where you don’t need to pretend, and yet you might have to keep one or two things in mind. Home is what helps you evolve through comfort and discomfort; where you can be carefree, yet you care. Home is not an idealistic notion characterized by happiness and positivity only; home is rather an oxymoron, the conglomeration of the dark and the light; home will break you at times, so that you can resurge again like a phoenix.

Home is the mirror, something that “shows you what is holding you back”, the entity which “brings you to your own attention so you can change your life.” (Elizabeth Gilbert). Home is not static; home is not one word that can be cocooned into boxes. Home is not a destination, it is a journey, a way of life. Home is manifold, it is “weird, messy, complicated, sad, wonderful, amazing and above all epic.” (Vampire Diaries). Home can be both the order and the chaos, and it is this ambiguity and ambivalence that drives us all, making us yearn for a home that is ever in the making. So, the next time you are bombarded with a question, it is okay if you grope to define home; often, the easiest questions are most difficult to answer.

Home is “not a place but a moment, and then another, building on each other like bricks to create a solid shelter that you take with you for your entire life, wherever you may go.” (Sarah Dessen). Sometimes to find your metaphorical home you got to forgo your physical home. But no matter how much of a wanderlust you might be, at the end of a long journey and search, what your heart craves for is the known smell which is synonymous with home. Home might be shabby or cloistered, far removed from your ideal dreams, but it is still your home, cause warmth, passion, care is what it takes to call it a home. Home is rare to find; its definition changes from time to time and our eternal search for it keeps us going.




বার, রবিবার

তন্ময় ভট্টাচার্য


শীতকাল আসলে এক সান্ত্বনার মরসুম। জলতেষ্টা এড়ানোর। প্রেমিকার বিয়ের খবর পেয়েতছনছ করতে চাওয়া সবকিছু। কিংবা তার হাত ধরে যা কখনও বলোনি। পঁচিশ পেরিয়ে গেছে অনেকদিন। এ-বয়সে একগ্লাস মদ অনেককিছু সহজ করতে পারে। টেবিলে উল্টে বদলে দিতে পারে প্রসঙ্গ। টিপসের অপেক্ষায় চঞ্চল হয়ে উঠছে ওয়েটারের চোখ। তুমি প্রেমিকার কানে-কানে কথা চাইছ। বিরহের অছিলায় ছুঁতে চাইছ শেষ মুহূর্তের ঠোঁট। শীতকাল আসলেই এক সান্ত্বনার মরসুম। তিরিশ টাকা কম পেয়েব্যাজার মুখে সরে গেল ওয়েটারও। তুমি মেয়েটির ওভারকোট থেকে সরছ না। বিয়ে কল্পনা করেরেজিস্ট্রি অফিস থেকে সরতে পারছ না তুমি। সাক্ষী হিসেবে অন্তত তিনজনের সই। মালাবদল অব্দি পৌঁছতে আর কতক্ষণনেশা কাটলে বাড়ি ফিরবে না?

 





No comments:

Post a Comment