দ্বিতীয় বর্ষ ✦ প্রথম সংখ্যা
সাক্ষাৎ নারায়ণ দর্শন
সায়নদীপ সেনগুপ্ত
ছোটোবেলায় মা
যে ট্রেনে
অফিস থেকে
ফিরতেন সেই
ট্রেনের আওয়াজ
পেলেই বই
নিয়ে বসে
পড়তাম।
কারণ গোটা
দিন কেটে
গেলেও শিরে
সংক্রান্তি না
হলে কাজ
শেষ করা
টা কোনোদিনই
আমার অভ্যাসে
নেই।তাই মাঝে
মাঝেই কপালে
জুটতো উত্তম
মাধ্যম মার।
এহেন ছেলেকে
কথা শোনাতে
গেলে কি
ঠিক জিনিস
লাগবে তা
আমার মা
বুঝে নিয়েছিলেন।
তাই যেদিন
একটু ঠিক
ঠাক পড়াশোনা
করতাম, তার
পরের দিন
মায়ের ব্যাগ
থেকে বেরোতো
দুই মলাটের
একটা পাতলা
চটি বই। তার
মলাটের উপর
কখনো থাকতো
বাঁটুল, কখনো
হাঁদা ভোঁদা,
কখনো বা
নন্টে ফন্টে,
কেল্টুদার ছবি। সাদা
কালো অথবা
কমলা রঙের
সেই ছবিতে
বলা গল্প
গুলোকে যে
কমিক্স বলে
তা তখনো
জানতাম না।
মনে আছে
মা বাবা
যখন অফিসে
থাকতো তখন
শীতকালের দিনেও
স্যান্ডো গেঞ্জি
আর কালো
বারমুন্ডা পরে
কতবার বাঁটুল
হয়ে ওঠার
চেষ্টা করেছি। বুক
চিতিয়ে দাঁড়িয়েছি
কাল্পনিক শত্রুর
গুলির সামনে।
বানানোর চেষ্টা
করেছি নণ্টের
বানানো পকেট
পিচকারি কিংবা
ভোঁদার মত
চুলের স্টাইল
(অবশ্যই জল
দিয়ে, কারন
তখন হেয়ার
জেলের কনসেপ্ট
ছিল না
আমার), সফল
হয়েছি ক'বার তা মনে
নেই, কিন্তু
নারায়ন দেবনাথ
নাম টা
জুড়ে গিয়েছিল
জীবনের সাথে।
এর কিছুদিন
পরে হাতে
পেলাম একটা
ম্যাগাজিন।
শুকতারা।
খুব সম্ভবত
আমার কোনো
এক তুতো
দাদা দেখিয়েছিল
আমাকে।
শুকতারার কভারে
তখন থাকতো
'কৌশিকের এডভেঞ্চার'।
রঙিন কমিক্স
বলতে প্রথম
ছিল সেটাই। ইস্পাতের
ডান হাত
নিয়ে কৌশিকের
সেই সব
দুর্ধর্ষ অ্যাকশান
প্যানেল গুলো
সত্যিই শিহরিত
করত আমায়। শুধু
ভাল লাগত
না কেন
মাত্র চারটে
প্যানেলই থাকে
কভারে, আর
আবার অপেক্ষা
করে থাকতে
হয় পরের
সংখ্যার জন্য। তবু
ভালো যে
ম্যাগাজিনের প্রথম
দু পাতায়
বাঁটুল আর
শেষ দু
পাতায় হাঁদা
ভোঁদার গোটা
একটা গল্পই
থাকত।
এরপর ধীরে
ধীরে পরিচিত
হলাম বাহাদুর
বেড়াল , ডানপিটে
খাঁদু আর
তার কেমিক্যাল
দাদু, আরও
কত চরিত্রদের
সাথে।
তারপর কালের
নিয়মে, মোটা
মোটা পড়ার
বইয়ের ফাঁকে
আর খুঁজে
পেতাম না
সেই পাতলা
বইগুলোকে।
কিন্তু মনের
মধ্যে একটা
স্বপ্ন উঁকি
দিত বারে
বারে, যদি
একবার দেখা
পেতাম ওই
‘না’
সইয়ের পেছনে
লুকিয়ে থাকা
মানুষটাকে।
যার প্রতিটা
তুলির টান
রঙিন করে
তুলেছে আমার
ছোটবেলাটাকে।
শাহরুখ খানের
একটা ডায়ালগ
আছে না-
“Agar kisi cheez ko shidhhat se chaho, to puri kayanat use tumse milane ki
koshish mein lag jate hein” বলতে গেলে
অনেকটা সেই
রকমই হল
আমার ক্ষেত্রে। ফেসবুকের
মাধ্যমে যোগাযোগ
হয় রাকেশ
দার সাথে। একদিন
নারায়ণ বাবুর
সাথে ছবি
পোস্ট করেছিল
দাদা।
সঙ্গে সঙ্গে
মেসেঞ্জার এ
হামলা করি। বলি,
আমিও দেখা
করে প্রণাম
করতে চাই
বাঁটুলের জন্মদাতাকে। দাদা
ওনার বাড়ির
ল্যান্ড নম্বরটা
দিলো আমায়। এরপর
যা হল
তা আমার
কাছে স্বপ্নের
চেয়ে কোনও
অংশে কম
নয়।
মোটামোটি দিন
চার পাঁচ
বাদে ওই
নম্বরটায় ডায়াল
করলাম আমি। কিছুক্ষণ
রিং হবার
পর একটা
বয়স্ক কণ্ঠস্বর
ভেসে আসলো
ওপাশ থেকে। ‘হ্যালো?’।
ব্যাস, থেমে
গেলাম কিছুক্ষণের
জন্য।
যে গলাটা
আমি শুনছি
সেই গলাটাই
কি সেই
মানুষটার, যিনি
বছরের পর
ধরে সৃষ্টি
করে গেছেন
এক কিংবদন্তীর। ধাতস্ত
হতে সময়
লাগল।
তারপর বাকি
কথাটা হল
ঠিক যেন
কোন এক
নাতি তাঁর
দাদুর বাড়ি
যাবে বলে
এক্সাইটেড হয়ে
দাদুকে ফোন
করেছে।
কথা হল
যে যাব
ওনার বাড়ি,
খুব তাড়াতাড়ি।
দিন কয়েক
পরে বাসে
করে যখন
শিবপুরের দিকে
যাচ্ছিলাম তখনও
ভাবছিলাম কি
বলব গিয়ে?
কিভাবে শুরু
করব কথা?
কতক্ষণই বা
কথা বলতে
পারব ওনার
সাথে? এই
সব ভাবনা
মাথায় নিয়েই
নামলাম মন্দিরতলা
বাসস্ট্যান্ডে।
কয়েকটা দোকানে
জিজ্ঞেস করে
বাড়ি খুঁজে
পেতে অসুবিধা
হল না
খুব একটা। একটা
নিপাট মধ্যবিত্ত
বাড়ি, আর
সেটাই নাকি
এক ইতিহাসের
আঁতুড়ঘর!
স্টাডিতে ঢুকতেই
দেখতে পেলাম
সেই বিখ্যাত
টেবিল, যেখানে
বসেই সৃষ্টি
হয়েছে একের
পর এক
কালজয়ী কমিক্স
প্যানেল।
আর টেবিলের
সামনে লুঙ্গি
আর গেঞ্জি
পরে বসে
খবরের কাগজ
পড়ছেন সেই
কিংবদন্তী।
ছোট্ট অশীতিপর
সেই ঘরটায়
যে কটা
আলমারি আছে
তার প্রত্যেকটাতে
ঠাসাঠাসি করে
রাখা একগাদা
পুরস্কার।
অথছ পরিপাটি
করে সাজানো
আছে দুটো
সোফাসেট।
খুব সহজভাবেই
বোঝা যায়
মানুষের ভালবাসার
চেয়ে বড়
কোন পুরস্কার
হতে পারে
বলে তিনি
মনে করেন
না।
কানে ভালো
করে শুনতে
পাচ্ছিলেন না
বয়সের ভারে,
তবু মনোযোগ
দিয়ে উত্তর
দেবার চেষ্টা
করছিলেন আমার
সমস্ত কৌতূহলের। কেমন
আছেন জিজ্ঞেস
করতে হাল্কা
হেসে বললেন-“চোখের সামনে, অনেক
কিছুই তো
দেখলাম।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
হতে দেখেছি
নিজের চোখে। মনের
জোরটা তাই অনেকটা বেশি। তার
উপর ভর
করেই, এই
তো, দিব্যি
আছি এখন।“
ধিরে ধিরে
কথা আরও
এগোল বেশ
কিছুক্ষণ।
জানতে পারলাম
শিবপুরের পাড়ার
গলি থেকে
হাঁদা ভোঁদা
দের বইয়ের
পাতায় উঠে
আসার গল্প। পরিবর্তন
উপন্যাসের অলঙ্করন
কিভাবে সৃষ্টি
করল নন্টে
আর ফন্টের
এক অটুট
বন্ধুত্বের, কিংবা
কুস্তির আঁখরা
থেকে কিভাবে
আমার তোমার
সকলের প্রিয়
দাদা হয়ে
উঠল, বাঁটুল। তিন
বছর আগে
হওয়া সেই
কথোপকথনের লাইন
বাই লাইন
আমার মনে
নেই।
শুধু এটুকু
জানি, সেদিন
কমিক্স আর্টিস্ট,
সাহিত্যিক, শিল্পী
নারায়ন দেবনাথ
কে ছাড়িয়ে,
একটু হলেও
চিনতে পেরেছিলাম
মানুষ নারায়ন
দেবনাথ কে,
যা আমার
সারা জীবনের
সম্বল হয়ে
থাকবে।
বেরবার আগে,
অতি নির্লজ্জের
মত করেই
ফেললাম সেই
চিরাচরিত আবদারটা। “স্যার,
একটা অটোগ্রাফ-“
বিনা বাক্যব্যায়ে
তুলে নিলেন
মার্কারটা, নিখুঁত
হাতে আমার
ডায়রির পাতায়
ধীরে ধীরে
ফুটে উঠল
বাঁটুল, “ওনার
প্রিয় ছেলে”।
তার নিচে
লিখে দিলেন
একটা ছোট্ট
শুভেচ্ছাবার্তা।
আমি ঠিক
কতটা সৌভাগ্যবান
আমি জানি
না, কিন্তু
আমার ফোনে
পুরো আঁকার
ভিডিওটা তুলতে
পেরেছিলাম আমি। ঐতিহাসিক
সেই ভিডিওটা
আজও যত্নে
রাখা আছে
আমার কাছে। আর
ডায়রির সেই
পাতাটা ফ্রেম
করে রেখে
দিয়েছি আমার
ঘরে।
দু চারটে
সেলফি তুলে,
ওনাকে প্রণাম
করে যখন
মন্দিরতলা বাসস্ট্যান্ডের
দিকে পা
বাড়ালাম, তখন
মনের মধ্যে
কয়েকটা প্রশ্ন
ঘুরপাক খাচ্ছিল
বারে বারে। এত
বড় একজন
মানুষের এত
আটপৌরে জীবন
যাপন! কিকরে
এত অসাধারন
হয়েও, এত
সাধারন হয়ে
থাকতে পারেন
একজন মানুষ!
এতক্ষণ যেটা
আমার সাথে
ঘটলো সেটা
স্বপ্ন, না
সত্যি?
দাঁড়িয়ে পরলাম
কিছুক্ষণের জন্য। ব্যাগ
থেকে বের
করলাম ডায়রিটা। বাঁটুলের
ছবির নিচে
সেই বিখ্যাত
সই, ‘না’।
ঠিক একই,
বইয়ের কমিক্স
গুলোর মতই। এক্কেবারে
এক।
সত্যিই স্বপ্ন
সত্যি হয়
তাহলে।
শাঁওলী মিত্র স্মরণে
সঞ্চারী সিনহা রায়
রবি ঠাকুর
যখন মারা
যান, তখন
শঙ্খ ঘোষের
বয়স ৯
। সেই
বিশেষ দিনটিতে
প্রতিটা বাঙালির
কিছু নিজস্ব
প্রতিক্রিয়া ছিল,
নিজের মতো
করে এই
আঘাতকে বুঝে
নেওয়ার এক
চেষ্টা।
ঠিক যেমন
ছিল সেই
নবম বর্ষীয়
বালকের।
কোলে ধরে
থাকা বই
থেকে রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের নামটা
খুঁজে তার
নামের আগে
এঁকে দিয়েছিলেন
একটি নিখুঁত
চন্দ্রবিন্দু।
এটুকুই।
মৃত্যু রহস্যময়। কিন্তু
মৃত্যুর পরই
কেন শিল্পীরা
এতো বেশি
প্রিয় হয়ে
ওঠেন, কেন
ছোটো থেকে
বড়ো সবাই
নিজের মতো
করে প্রতিক্রিয়া
দিতে শুরু
করেন তাদের
নিয়ে, কেন
যে তাদের
জীবন সাদা
কাপড়ে আচ্ছাদিত
মায়ার মতো
মনে হতে
থাকে, বা
মনে করানো
হয়ে থাকে
- সে রহস্যের
জটিলতা মৃত্যুকেও
হার মানাবে। একটা
মানুষ তার
পুরোনো শরীর
এবং পরিচয়
ছেড়ে গেছে। এই
কিছুক্ষণ আগে। অমনি
ভীষণ হুলস্থুল। "কে যায়? ও
কে? কী
করে গেলেন
তিনি?... ওমা তাই নাকি!
অপূরণীয় ক্ষতি।..." তাড়াতাড়ি খাতা
কলম নিয়ে
প্রস্তুত হতে
হয়।
ক্ষতির হিসাব
লিখতে হবে। এ
মানুষের আদ্যি
কালের স্বভাব। ক্ষতি
নিয়ে, চলে
যাওয়া নিয়ে,
অনুপস্থিতি নিয়ে
বড়ো বেশি
কথা বলে
মানুষ... পাওয়া নিয়ে, উপস্থিতি
নিয়ে কি
ততোটা বলেছিল?
মহাভারতের পরতে
পরতে ক্ষতির
হিসাব বেড়ে
চলে, অধর্ম
বাড়ে, যন্ত্রণা
বাড়ে... সঙ্গে আমাদের হাহুতাশ। কিন্তু
এতো বড়ো
মহাকাব্যে প্রাপ্তির
হিসাব কি
নেহাতই কম?
কই... তাই নিয়ে কথা
বলি না
তো আমরা!
তাই মহাভারতের
সবচেয়ে আলোচিত
অংশ হয়ে
দাঁড়ায় দ্রৌপদীর
বস্ত্রহরণ।
শাঁওলী মিত্রের
মৃত্যুর খবরের
সঙ্গে সঙ্গে
যে ভিডিওটা
দ্রুত ঘুরতে
থাকে সোশ্যাল
মিডিয়ার দেওয়ালে
দেওয়ালে, সেটা
" নাথবতী অনাথবৎ
" থেকে তুলে
নেওয়া দ্যূতক্রীড়ার
অংশ।
পাণ্ডব এবং
দ্রৌপদীর অসহায়তার
অংশ।
আসলে বড়ো
অসহায় হয়ে
পড়েছি আমরা
ভিতরে ভিতরে। বড়ো
কোণঠাসা।
একজন নাট্যব্যক্তিত্ব,
একজন লেখিকা,
কিংবা একজন
শিল্পী চলে
গেলে - আমাদের
গলার স্বরটুকু
চলে যায়। এই
ধ্বংসের খেলার
মাঝে দাঁড়িয়ে
অমৃতসমান কথা
বলার সাহসটুকু
চলে যায়। শঙ্খ
ঘোষের মৃত্যুর
পর, শিরদাঁড়া
গুটিয়ে নিয়েছি
অনেকেই, আর
শাঁওলী মিত্র
যেন জমিয়ে
রাখা শেষ
দু'আনা
সাহসও সঙ্গে
করে নিয়ে
গেলেন।
তাঁর মৃত্যুর
পর রুদ্রপ্রসাদ
সেনগুপ্ত একটি
সাক্ষাৎকারে বলেছেন,
শম্ভু মিত্র
আর তৃপ্তি
মিত্রের সব
ভালোটুকু নিয়ে
তৈরী হয়েছিলেন
শাঁওলী মিত্র। সত্যিই
তো তাই;
" কথা আমৃতসমান",
" নাথবতী অনাথবৎ
" বা
' সীতাকথা' নাটকে
আমরা যে
বহুকণ্ঠী শাঁওলীকে
শুনি, তার
মধ্যে এক
হয়ে যায়
শম্ভু মিত্র
ও তৃপ্তি
মিত্রের কণ্ঠ। কথকের
আশ্চর্য সাবলীল
দ্রুততা অনিবার্য
ভাবে আমাদের
মনে করিয়ে
দেয় তৃপ্তি
মিত্রের কথা,
আর অন্য
দিকে নরম
নারী কণ্ঠ
যখন বদলে
যায় দুর্যোধনের
গম্ভীর পুরুষ
কণ্ঠে - অ্যাকাডেমির
আধো আলোয়
দেখি এক
পিতার ছায়া
পড়েছে তার
কন্যার ওপর
- যে ছায়ায়
আজীবন আশ্রয়
খুঁজবেন শাঁওলী,
এমনকি মৃত্যুতেও।
আত্মাভিমান করার
মতো কারণ
কি কম
ছিল তাঁর?
ঋত্বিক ঘটকের
সিনেমায় অভিনয়
ছিল ( যুক্তি
তক্কো গল্প)
, হাতে গড়া
পঞ্চম বৈদিক
ছিল, সাড়া
ফেলে দেওয়া
নাটক ছিল,
বই ছিল,
পড়াশোনা ছিল,
নিজস্ব ভাবনার
পরিচয় ছিল,
সঙ্গীত নাটক
অ্যাকাডেমি থেকে
শুরু করে
পদ্মশ্রী অবধি
পুরস্কার ছিল...
কী নেই!
কিন্তু তারপরও,
তিনি বেশিরভাগ
আমন্ত্রিত সভায়
কথা বলতেন
শম্ভু মিত্রের
থিয়েটার দর্শন
নিয়ে, বই
লিখতেন তাঁকে
নিয়ে, এমনকি
সভার শেষে
বা নাটকের
শেষে কেউ
বই বাড়িয়ে
দিয়ে একটা
সই এর
আবদার রাখলে
তাঁর কথা
মনে করিয়েই
বলতেন, " আমি অটোগ্রাফ দিই
না।
বাবা নিষেধ
করেছিলেন"।
মৃত্যুর পর
প্রকাশিত তাঁর
ইছাপত্রের ছবিতে
আমরা শুনি
সেই শান্ত
দৃপ্ত স্বরে
শাঁওলী মিত্র
বলছেন,
" আমার একান্ত ইচ্ছে,
আমার পিতাকে
অনুসরণ করেই
মৃত্যুর পরে
যতো দ্রুত
সম্ভব আমার
সৎকার সম্পন্ন
করা হয়। ঐ
শরীরটিকে প্রদর্শন
করায় আমার
নিতান্ত সংকোচ। ফুলভারের
কোনো প্রয়োজন
নেই।
সামান্য ভাবে
সাধারণের অগোচরে
যেন শেষকৃত্যটি
সম্পন্ন করা
হয়" ।
তিনি আরও
বলছেন, "প্রচুর মিথ্যা আমাকে
উদ্দেশ্য করে
বর্ষিত হওয়া
সত্ত্বেও আমি
আমার দর্শকের
কাছে, আমার
পাঠকের কাছে,
বহু সাধারণ
মানুষের কাছে
অসীম শ্রদ্ধা
ভালোবাসা পেয়েছি।"
পড়তে পড়তে
মনে পড়ে
আরেক মৃত্যুর
কথা।
অর্থাভাবে প্রায়
বিনা চিকিৎসায়
মারা গেছেন
মানিক বন্দ্যোপধ্যায়। আর,
মৃত্যুর খবর
জানাজানি হতে
জনঅরণ্য
ঘিরে ধরেছে
তার নিথর
অস্তিত্ব।
ফুলের ভারে
ভেঙে পড়েছে
শববাহী খাট। সে
দৃশ্য দেখে
কবি সুভাষ
মুখোপাধ্যায় লিখছেন
-
"ফুলগুলো সরিয়ে নাও,
আমার লাগছে।
মালা জমে
জমে পাহাড়
হয়
ফুল জমতে
জমতে পাথর।
পাথরটা সরিয়ে
নাও,
আমার লাগছে।"
এ মৃত্যুর
ছবি আমাদের
বড়ো চেনা। বেঁচে
থাকতে দিক
বা না
দিক, মৃত্যুর
পর মর্যাদা
জানাতে ভোলে
না আমাদের
রাষ্ট্র।
বন্দুকের শব্দে
উড়ে যায়
আশপাশের গাছের
কাক, শকুন
এবং শালিকরা। সেই
রাষ্ট্রকে - সেই
বন্দুকের বন্দনায়
বিদায় সম্ভাষণ
জানানোর রেওয়াজকে
চুপ করিয়ে
দিতে পারেন
শাঁওলী।
শাসকের হাত
থেকে তাঁর
পুরস্কার কিংবা
পদমর্যাদা গ্রহণ
নিয়ে না
ভেবে প্রশ্ন
তুলেছিলেন যে
প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবীরা,
তাদের চুপ
করিয়ে দিতে
পারেন, দিতে
জানেন তিনি। বাবার
শিক্ষাকে দৃষ্টান্ত
করে রেখে
যান, যেন
যেতে যেতেও
আমাদের শিখিয়ে
চলেছেন মাথা
উচুঁ করে
বাঁচার পাঠ। শিখিয়ে
চলেছেন
' কথা অমৃতসমান'
, একান্ত শাঁওলীময়
ভঙ্গিতে:
" আমাদের সন্ততিদের জন্যে
ন্যায়, নীতি,
সত্য, মনুষ্যত্ব
প্রতিষ্ঠিত করতে
দাও।
আমাদের সন্ততিদের
জন্যে অন্তত
এই পৃথিবীটাকে
ভালো করে
দাও" ।
বাংলা গান
বেশ কিছুদিন আগে একটি বই আমার হাতে এসে পড়ে। এ বইয়ের বিষয়বস্তু বিংশ শতাব্দীতে বাংলা গানের ইতিহাস, বিবর্তন, এবং বর্তমান পরিস্থিতি, লেখক কবীর সুমন। সুমনের গানের একজন আজীবন অনুরাগী হবার পাশাপাশি তাঁর লেখাও আমি আগ্রহ নিয়ে পড়ে থাকি। ফলে বইটি শেষ করে ফেলতে বেশী সময় নিই নি। সুমন তাঁর সুমনোচিত লেখনীতেই গত একশো বছরের বাংলা আধুনিক গান নিয়ে এক আশ্চর্য দলিল প্রস্তুত করেছেন, যা বরাবরের মতই গানের যে কোনো ছাত্রকে সমৃদ্ধ করতে বাধ্য। তবে বইটির শেষ অংশে এসে লেখকের বক্তব্যে বেশ খানিকটা হতাশা চোখে পড়ে। এই হতাশার মূল বিষয়বস্তু- নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত যে মানের, যে পরিশীলনের বাংলা গান তৈরী হয়েছে, তেমন গান নাকি আর হচ্ছে না। আজ বন্ধু দেবার্ঘ্যর নির্দেশে বাংলা গানের সমসাময়িক যাত্রা বা দিশা নিয়ে এই লেখাটি লিখতে বসে সুমনের ঐ বইয়ের শিরোনামটিই মনে পড়ছে- “কোন পথে গেলো গান?”
বাংলা গান কোন পথে যাচ্ছে, বা বেপথে যাচ্ছে কি না, সে বিষয়ে এতবার আলোচনা হয়েছে, এত মানুষের এত রকমের মতামত,যে এ নিয়ে কিছু লেখার আগে একটু ইতস্তত বোধ করতেই হয়। বিশেষ করে লেখক যদি আমার মত কেউ হয়, যে নিজেও বর্তমানে বাংলা গান তৈরী করার কাজের সঙ্গে যুক্ত, তখন স্বাভাবিকভাবেই পক্ষপাতদুষ্ট লেখক হয়ে পড়ার অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে যে কথাটা দিয়ে শুরু না করলেই নয়, সেটা এই, যে গান “ঠিক” বা “ভুল” পথে যাচ্ছে কি না, এ তর্কটার আসলে কোনো নির্দিষ্ট অর্থ নেই।কোনোরকম শিল্পের ব্যাপারেই এইভাবে যাত্রার পথ-বেপথ চিহ্নিত করে দেওয়া যায় না, কারণ শিল্পের কদর জিনিসটা আদতেই আপেক্ষিক এবং সাবজেক্টিভ (subjective)। যেমন, নিজে সাহিত্যের গবেষক এবং শিক্ষক হয়েও বিশ্ববরেণ্য লেখক জেমস জয়েসের লেখা আমার ভালো লাগে না, আবার আমার বহু সহকর্মীই জয়েসকে প্রায় ঈশ্বরের মত শ্রদ্ধা করেন। আবার জাপানী রন্ধনশিল্প, অর্থাৎ সুশি-সাশিমি গোত্রের রান্না আমি পাগলের মত ভালোবাসি, কিন্তু আমার বাবাকে খাওয়াতে গেলে তিনি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান। গানের ব্যাপারটাও এরকমই। যার যেরকম রুচি।
গান কোন পথে যাচ্ছে, সে বিষয়ে আমার বন্ধু এবং গুরুস্থানীয় শিল্পী রূপম ইসলামকে প্রশ্ন করায় তিনি বলেন, “দ্যাখ, এটা তো দৃষ্টিভঙ্গীর উপরেই সম্পূর্ণনির্ভরশীল, কে কোন জায়গায় [ফোকাস করছে বা] নিজেকে আটকে ফেলছে। না হলে জিনিসটা কখনোই আটকে থাকছে না, টুক টুক করে নিজের গতি বা অভিযোজন তৈরী করতে করতেই এগোচ্ছে।“ গান আবহমান এবং বহুমাত্রিক, তার পথ-বেপথ চিহ্নিত করতে যাওয়া মানে আসলে তার স্রোতকে জোর করে রূদ্ধ করতে চাওয়া। আমার মতে শিল্প নিয়ে ভাবার এটাই দ্বন্দমূলক (dialectic) পদ্ধতি, অতএব একমাত্র কার্যকরী পদ্ধতি। তবে জনপ্রিয় ভাষ্যে লক্ষ্য করেছি, গান নিয়ে আলোচনার নিরিখে মূলত দু’ ধরণের বক্তব্য এই সুরসিক ভাবনাকে ছাপিয়ে যেতে চায়। এদের এক পক্ষের দাবী, আগে যা হয়েছে তাই ভালো, পরে যা হয়েছে তা অবান্তর।অতীতের কালোয়াতি বনাম বর্তমানের অপক্কতা মার্কা একটি মিথ তৈরী করার চেষ্টা করেন এই পক্ষের বক্তারা। আবার অপর পক্ষের দাবী, আগে যা হয়েছে সব সেকেলে এবং বস্তাপচা, নতুন মানেই বৈপ্লবিক, তার মান যেমনই হোক, নতুন বলেই তাকে স্বাগত জানাতে হবে। এই দুই একমাত্রিক ভাবনার যুদ্ধের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটু মনে করিয়ে দেওয়াই প্রয়োজন, গান বা শিল্পের কদর করাটা কখনোই স্ব স্ব অবস্থানের দ্বারা প্রভাবিতগোঁড়ামির (dogmatism) জায়গায় নিয়ে যাওয়া উচিত নয়।
তবে এ কথাটা মাথায় রেখেই এবার আসি পথের প্রশ্নে- আসলে কি গান কোনো পথে চলছে না (“এগোচ্ছে” কথাটি ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেলাম, ওর মধ্যে প্রগতির একটা ঈঙ্গিত আছে যেটা অতিসরলীকরণ হয়ে যায়)? অবশ্যই চলছে। সেই পথের হদিস খুঁজতে গিয়ে যে কথাটি বার বার উঠে আসে, সে’টি হচ্ছে গানের প্রাসঙ্গিকতা। প্রাসঙ্গকিতার বিচার করবো তা হলে কোন মাপকাঠিতে বা প্যারামিটারে (parameter)? এ বিষয়ে একটু অনুসন্ধান করতে গিয়ে শ্রী সুধীর চক্রবর্তীর লেখায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য খুঁজে পাচ্ছি। ১৯৯০ সালের একটি বইতে সুধীরবাবু লিখছেন, “আধুনিক বাংলা গানের জগত এক বিচিত্র সম্পর্কহীনতার সুতোয় দুলছে। কারোর জন্য কারোর দায় নেই সেখানে। শিল্পী বলছেন শ্রোতারা এমন চাইছেন, শ্রোতারা বলছেন শিল্পী রুচিদুষ্ট, প্রযোজক ভাবছেন বাজারের কথা, সমালোচক বলছেন ‘গেল গেল’… বাংলা গানের উৎসারণের জন্য শুধু অর্থনৈতিক সচ্ছ্বলতা থাকলে চলবে না। চাই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও উদার সাংস্কৃতিক মনোভাব… এ কথা আমরা যতদিন না বুঝবো তত দিন আধুনিক বাংলা গান হয়ে থাকবে স্ববিরোধের শিল্প।“ আজ এই লেখায় সুধীরবাবুর মূল্যায়ন থেকে ধার নেবো তিনটি আঙ্গিক। প্রথমত, দৃষ্টিভঙ্গি, বা গানকে মাধ্যম হিসেবে ব্যাবহার করে যুগের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করা। দ্বিতীয়ত, উদার সাংস্কৃতিক মনোভাব, বা অন্য ধারার গানকে, মূলত বিদেশী ধারাকে, নস্যাৎ না করে দিয়ে তাকে বাংলার এবং বাঙালীর সাঙ্গীতিক জীবনের পরিপূরক করে তোলার ক্ষমতা। তৃতীয়ত, স্ববিরোধ এড়িয়ে গিয়ে এক ধরণের স্থিতি বা consistency, অর্থাৎ বর্তমান বাংলা গানে আমি একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীচরিত্র পাচ্ছি কি না (এবং আমার মার্ক্সীয় চিন্তা বলে, শ্রেণীচরিত্র মানেই কোনো এক সংগ্রামের পরিচিতি)। এই তিন আঙ্গিক থেকে যদি সমসাময়িক বাংলা গানকে একটু দেখতে চেষ্টা করি, তবে কোন পথে সে চলেছে তার খানিক হদিস মিললেও মিলতে পারে।
শুরু করার আগে বলেই রাখি, এ লেখায় আমি নব্বইয়ের দশকের শেষের দিক থেকে যে সব গান তৈরী হয়েছে, মূলত সেই সব গান নিয়েই আলোচনা করবো। এ সিদ্ধান্তের দু’টি কারণ আছে। প্রথমত, নিজে যে গানের আখরে আমি বড় হয়েছি, তা নিয়ে লেখাই কার্যকরী বলে মনে করি। কারণ, যা চোখে দেখিনি তার বৃহত্তর ইতিহাস-চর্চায় যে ছোটোখাটো, ইন্টারেস্টিং ভাবনাগুলো মাঝেমাঝে হারিয়ে যায়, কিশোর বয়সের ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতায় অনেক সময়ে সেগুলো চমৎকার মনে থাকে। আসলে আমি অনুমানধর্মী লেখার চেয়ে বর্তমানধর্মী লেখায় বেশী সাবলীল বোধ করি। দ্বিতীয়ত, নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত আধুনিক বাংলা গান নিয়ে আমাদের গুরুস্থানীয়রা যতটা লেখালিখি, যতটা চর্চা করেছেন, আশ্চর্যভাবেই পরবর্তী যুগের গান সিরিয়াস লেখালিখিতে ততটা জায়গা পায় নি, বরং খানিকটা অবহেলিতই থেকে গিয়েছে। এর পিছনে কারণ কী হতে পারে, এবং এর ফলে মধ্যবিত্ত, “সংস্কৃতিমনস্ক” বাঙালী জনসমাজের চোখে সমসাময়িক গান নিয়ে কেমন চিত্র ফুটে উঠেছে, আশা করছি আমার আলোচনার মধ্যে থেকেই এ সব প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর উঠে আসতে পারে।
ওপার বাংলার গান- ১৯৭১ থেকে শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা এবং কিছু কথা
বাংলা গান নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মূলধারার লেখালিখিতে বা আলোচনায় প্রায়শই একটা বড়সড় ফাঁক দেখা যায়- বাংলাদেশের আধুনিক বা সমকালীন গান নিয়ে আলোচনার অভাব। কোনো কোনো গুরুস্থানীয় শিল্পী অবশ্য খুবই চেষ্টা করেছেন এবং করছেন বাংলাদেশের গানকে আমাদের আলোচনার অঙ্গ করে তুলতে, তবে আমার মত আমার প্রজন্মের অনেকেই সেইভাবে বাংলাদেশের ব্যান্ড বা সোলো শিল্পীদের নিয়ে চর্চা করার সুযোগ পান নি। যেহেতু আমি নিজে মূলত এপার বাংলার গান নিয়েই বেশী ওয়াকিবহাল, তাই আমার আজকের আলোচনাটি মূলত এপারের গানেই সীমিত রাখবো। তবে বাংলা গান নিয়ে লিখতে বসে বাংলাদেশের গান নিয়ে একেবারেই কোনো কথা না বলাটা ধৃষ্টতা হবে। এ বিষয়ে আমার বন্ধু এবং দেশবিদেশের গানের একজন জলজ্যান্ত এনসাইক্লোপিডিয়া ডক্টর ইশতিয়াক ইসলাম খান আমাকে বহু তথ্য পাঠিয়ে সাহায্য করেছেন। ইশতিয়াকের কাছে যা জেনেছি, তার থেকে একটু বেছে নিয়ে ওপার বাংলার গান নিয়ে কিছু খুবইসংক্ষিপ্ত মন্তব্য না করলেই নয়।এখানে আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা থেকে শুরু করে নব্বইয়ের দশকের শেষ পর্যন্ত ওপার বাংলার গানের একটা সারাংশ দেবার চেষ্টা করছি। দু’হাজার সালের পর থেকে যে বাংলাদেশী শিল্পীরা গান বেঁধেছেন, গেয়েছেন, তাঁদের কথা আমার মূল আলোচনায় ফাঁকে ফাঁকে এপারের শিল্পীদের পাশাপাশিই এসে পড়বে।
বাংলাদেশের “গানের সার্কিট” বলতে গোটা দেশের সঙ্গীতজগতকেই ধরা হয় বটে, তবে মূলত সেই জগতটাকে ঢাকা এবং চট্টগ্রাম-কেন্দ্রিক বলা যায় (যদিও আন্ডারগ্রাউন্ড বা ব্যান্ড সঙ্গীতের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি রয়েছে সিলেট এবং রাজশাহীতেও)। পেশাদারীভাবে গানবাজনা করতে হ’লে সচরাচর শিল্পীদের একটা না একটা সময়ে ঢাকাতেই বাসা বাঁধতে হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পরেবাংলাদেশে জনপ্রিয় পপ মিউজিকের একটা সাঙ্গীতিক আন্দোলন শুরু হয়, তার পাশাপাশি ব্যান্ডের গানের আদি যুগও এইটি। আমার বিশ্বাস, এই সাঙ্গীতিক আন্দোলনের পিছনে ছিলোপূর্ব পাকিস্তানের থেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি নবীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার পথেও একটি সচেতন পদক্ষেপ নেবার গভীর বাসনা। এই আদি পর্বের গল্প বলতে গিয়েই ইশতিয়াক একটা কথা আমাকে বলেন। ওঁর মতে, “বাংলাদেশে আসলে সেই অর্থে সিংগার-সংরাইটারের ধারাটা খুব বেশী নেই, যেমন ওপারে সুমন-অঞ্জন-নচিকেতা-রূপম-শিলাজিত-অনুপম রায়, বা তুমি নিজেও। আমাদের বেশীরভাগটাই হয় পপ মুভমেন্ট নয় ব্যান্ড মুভমেন্ট। কিন্তু এই সময়ে কয়েকজনের নাম আমি করতে চাই, যারা সেই অর্থে সিংগার-সংরাইটার ছিলেন।“ এই প্রথম যুগের কিছু উল্লেখ্য নামের মধ্যে পাই আজম খানকে, যাঁকে “গুরুদেব” উপাধিতে ভূষিত করে ওপার বাংলার নতুন ধারার গানের জনক বলা হয়। আজম খান গীতিকার-গায়ক হিসেবে তেমন ক্রিটিক্যাল সাফল্য না পেলেও তাঁকে নিয়ে একটা আশ্চর্য উন্মাদনা ছিলো, তার একটা কারণ অবশ্যই মানুষটার ব্যাক্তিত্বের আকর্ষণ এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর নিজের ইতিহাস। এ যুগের আর একজন গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী ছিলেন ফকির আলমগীর, কিছুদিন আগে যিনি মারা গিয়েছেন। ইনি মূলত গণসঙ্গীতের ধারায় গান রচনা করতেন, “ও সখিনা”-র মত কিছু বিখ্যাত গান এঁরই কীর্তি। সমতুল্য সমাদর না পেলেও এঁর ধারার সঙ্গে এপার বাংলার শ্রোতারা খানিকটা মিল পেতে পারি প্রতুল মুখোপাধ্যায় বা ভূপেন হাজারিকার গানের। এঁদের পাশাপাশি বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের আদিপর্বও এই যুগে শুরু। সোলস, ডিফারেন্ট টাচ বা ফিডব্যাকের মত ব্যান্ড তখন যাত্রা শুরু করছেন। ইশতিয়াকের বক্তব্য, একটু সেকেলে গান রচনার “তুমি, আমি, ভালোবাসা, ও সজনী” ধারার ভাষ্যকে আধুনিক করে তোলার কাজে খানিকটা সাফল্য পেলেও এঁরা সম্পূর্ণভাবে ঐ ধারার থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন নি। তবে চরিত্রের দিক থেকে খুব বৈপ্লবিক না হলেও এই সময়ের ব্যান্ডের গান শ্রুতিমধুর ছিলো। যেমন সোলসের “মুখরিত জীবন” বা “এরই মাঝে রাত নেমেছে”-র মত গানে আমরা “ঝিনুক-শামুকে ভরা বালুর চরে/ ঢেউয়ের সাথে নেচেছি/রঙীন স্বপ্নে গাঁথা স্মৃতির মালা/ সৈকতে ফেলে এসেছি”-র মত সাবেকী উচ্চারণ পাচ্ছি। খানিকটা আমাদের এ পার বাংলার পরশপাথরের সঙ্গে এদের মিল রয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, প্যাটার্ন ভেঙে না বেরোলেও নান্দনিকতা (aesthetics) নিয়ে ভাবনাচিন্তা বাংলাদেশে এই সময়েই শুরু হয়ে গিয়েছিলো।
আশির দশকের গানে আমরা পাই লাকি আখন্দের মত খ্যাতনামা এবং শ্রদ্ধেয় সুরকারকে, “হ্যাপি টাচ” নামে একটি ব্যান্ডের সঙ্গে তাঁর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গানের খোঁজ পাওয়া যায়। তাঁর পাশাপাশি এই সময়ে বা এর কয়েক বছর পরেই ব্যান্ডের গানে একটি নতুন ধারা নিয়ে আসেন মাকসুদুল হক ওরফে “ম্যাক।“ নিজে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হয়েও বাংলা গীতরচনায় ম্যাক যে পরিবর্তন নিয়ে আসেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। পুরোনো প্যাটার্ন ভেঙে তাঁর লেখনীতে আমরা পাই “মনে পড়ে তোমায়”-র মত গান, যে গান বিবিসি বাংলার সেরা ১০০ লিরিকের মধ্যে রয়েছে। এ গানের লিরিক ছত্রে ছত্রে সিরিয়াস কাব্যিকতায় পূর্ণ; “মনেপড়েঅকালেআমারমনেরশান্তিমরেযায়/মনেপড়েবছরেবছরেগড়াসংসারেকিযেনহারিয়েযায়/মনেপড়েনিদ্রাহীনকতরাতেজেগেআছিভোরেরইআশায়।“ এই ছকভাঙা গান এবং কাব্যিকতা কিন্তু আকস্মিক ছিলো না, আমার মতে এর পিছনে খানিকটা হলেও রয়েছে বাংলাদেশের ব্যান্ড সংস্কৃতিতে বিদেশী ব্যান্ড নিয়ে চর্চার আগ্রহ। যেমন, ম্যাকেরই একজন সমসাময়িক শিল্পী, “নোভা” ব্যান্ডের সদস্য আহমেদ ফজল ছিলেন আর একজন দাপুটে সিঙ্গার-সংরাইটার। তাঁর গীতরচনায়, সুরে এবং গায়কীতে পিংক ফ্লয়েডের প্রভাব স্পষ্ট। “বীরশ্রেষ্ঠরা ফিরে এসো/ মায়ের আকাশে কালো মেঘ আবার”- “কথা রাখবো”র মত কিছু প্রতিবাদী গানের পাশাপাশি ইনি রাজাকারবিরোধী, নেশাবিরোধী গানের জন্যেও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
এ ধরণের ব্যান্ড সঙ্গীতের পাশাপাশি নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় বাংলাদেশে অবশ্য আর এক ধারার গানও আমরা পাচ্ছি, যার সমগোত্রীয় ধারা সেইভাবে এপার বাংলায় পাই না। অন্তত, অতটা জনপ্রিয় ভাবে তো নয়ই। এই সময়ে মূলত কিশোরদের শ্রোতা হিসেবে নিয়ে খুব অল্পবয়সী পপ শিল্পীদের গানের হদিস পাওয়া যায়, যার সঙ্গে তুলনা করা যায় সমকালের বিটিএস বা ওয়ান ডিরেকশন গোত্রের শিল্পীদের। এঁদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক এবং সুরকার খান আতাউর রহমানের পুত্র আগুন, ইশতিয়াকের ভাষায় যিনি ছিলেন একজন “teenage sensation।“ “সাডেন” বলে তাঁর ব্যান্ডের সঙ্গে “একান্তই আমার”-এর মত কিছু গান গেয়ে তিনি বেশ সাফল্য লাভ করেন। তবে ইশতিয়াকের মতে এই যুগে ব্যান্ডের গানে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল আসে, এবং এই বদল যে শিল্পীদের হাত ধরে আসে, আমরা এ পার বাংলার শ্রোতারা হয়তো তাঁদেরই সবচেয়ে বেশী চিনি। এঁদের মধ্যে রয়েছেন প্রয়াত আয়ুব বাচ্চু, জেমস, বা হাসানের মত ব্যান্ডশিল্পীরা। এঁদের মত শিল্পীদের নিয়ে গানের সংকলন করতেন বাংলাদেশে এ ধারার গানের একজন অত্যন্তদাপুটে গীতিকার, প্রিন্স মাহমুদ, যিনি আজও অত্যন্ত সমাদৃত। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই এঁর লেখা এবং সুর- “মা”, “বাবা,” “এত কষ্ট কেন ভালোবাসায়” ইত্যাদি। আয়ুব বাচ্চু অবশ্য নিজেও গান লিখতেন, তার মধ্যে “সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে’ গানটি এপার-ওপার নির্বিশেষে বাংলা ব্যান্ডের অনুরাগীদের মুখে মুখে ফেরে। তবে নিজেকে কখনোই মূলত গীতিকার হিসেবে তুলে ধরেন নি তিনি, বরং বহু ভালো গীতিকারকে তিনি জনসমক্ষে উঠে আসার রাস্তা করে দিয়েছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন বাপ্পি খান (“সুখ,” “হাসপাতালে”), বা লতিফুর ইসলাম শিবলি (“কষ্ট”, জেমসের “জেল থেকে বলছি”)। ইশতিয়াকের মতে এঁরা কেউ সরাসরি কবীর সুমনের ধারায় গান লেখেন নি বটে, তবে সুমন আধুনিক বাংলা গানে একটা নতুন জোয়ার নিয়ে আসায় নিজেদের গান নিয়ে নানারকম এক্সপেরিমেন্ট করার সাহস এঁরা পেয়েছিলেন। একইভাবে জেমস ১৯৯৫/১৯৯৬ সাল থেকে নিজের একটা ধারা তৈরী করেন, এবং সেই ধারার সৃষ্টি করতে তিনি সাহায্য নিয়েছেন আসাদুল্লা দেহলভি বা মারজুক রাসেলের মত কিছু গীতিকারদের যাঁরা মূলত জেমসের জন্যই গান রচনা করেন। হাসান আবার নিজেই নিজের গান লিখতেন, সেই জায়গাতে ইনি বাকিদের চেয়ে একটু আলাদা। এই সময়ে আরো বেশ কয়েকজন শিল্পী গীতিকার হিসেবে বেশ নাম করেন, এঁদের মধ্যে “ট্র্যাপ” ব্যান্ডের তরুণ মুনশী (“কিছু কিছু নাম্বার থেকে”, “দয়াল”) উল্লেখযোগ্য।
১৯৯৭/১৯৯৮ সালে বাংলা ব্যান্ডের গানে আবার একটা বাঁকবদল ঘটে, এযবং তার মূল কাণ্ডারী ছিলেন “দলছুট” ব্যান্ডের সঞ্জীব চৌধুরী। সঞ্জীব নিজে সাংবাদিক এবং একটিভিস্ট ছিলেন, এবং তার পাশাপাশি লিখতেন একটা স্বতন্ত্র ধারার গান। “সানগ্লাস,” “যাই পেরিয়ে” বা “এই নষ্ট শহরে”-র মত গান তৈরী করে তিনি ইশতিয়াকের ভাষায় একটি “কাল্ট ফলোয়িং” গড়ে তোলেন, যে ধারায় তাঁর অকালমৃত্যুর পরে তাঁর অনুগামীরা আজও গীতরচনা করে যাচ্ছেন। সাতাশ বছর বয়সী একজন মানুষের গানে সঞ্জীব লিখছেন, “আমার বুক দ্যাখাবো তোকে, বুকে রয়েছে বিদ্যুৎ/ কিছু করলি মনে? ধুত! আমি খেয়েছি স্বপ্নকে/ জানিস, বজ্র সখা আমার, আমার সাধ এখানে থামার/ তোর আঁচল পেলে বাতাস আর দরকার কী নামার?” সত্তরের দশকে সোলস বা ডিফারেন্ট টাচের যে ধারার, যে নান্দনিকতার আলোচনা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তার সাথে তুলনা করলে বেশ টের পাওয়া যায়, বাংলাদেশের গান শুধু নানা পথেই এগোয়নি, তার দর্শন-রাজনীতি-নন্দনতত্ত্ব, সব কিছু নিয়েই সে বেশ কয়েকবার আশ্চর্য বাঁকবদল করেছে।
নব্বইয়ের দশকের শেষের দিক থেকে বাংলাদেশে যাঁরা গান গেয়েছেন, বেঁধেছেন, তাঁদের মধ্যে কিছু শিল্পীর নাম এপার বাংলায় আমরা খুব ভালোভাবেই জানি, যেমন আনুশেহ আনাদিল, বা অর্ণব। আবার কারোর কারোর নাম একটু কম পরিচিত, যেমন পথিক নবী বা শান্তনু বিশ্বাস। এঁদের কথা আমার মূল আলোচনায় আসবে। তবে এই অংশে চেষ্টা করলাম বাংলাদেশের গানের কিছু ধারার একটা সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে দেবার। অনেকের নাম মিস করে গেলাম, অনেকের ব্যাপারেই খুব কম কথা বলা হ’লো। এ বিষয়ে যাঁরা আরো বিশদে জানতে ইচ্ছুক, তাঁরা ইশতিয়াকের লেখা “আমার অহংকার আমি গান শুনি এই যুগের” বইটি অবশ্যই সংগ্রহ করবেন এবং পড়বেন। ২০২০ সালে বর্ষা দুপুর প্রকাশন থেকে এই বইটি প্রকাশিত হয়।
উপরের এই আলোচনা থেকে যে বাংলাদেশের গানের কোনো একটি নির্দিষ্ট পথের সন্ধান পাওয়া গেলো, তা নয়। বস্তুত, তা আমার লক্ষ্যও ছিলো না। আসলে, “বাংলা গান আজ পথ হারিয়েছে” বা “আজকাল তো আর গানে কিছুই হচ্ছে না,” এ ধরণের নালিশের যদি কোনো মর্ম থাকে, তবে তা বাংলা গানের একটি স্বতন্ত্র পরিচিতির অনুপস্থিতি নিয়ে অভিযোগ (সে অভিযোগ প্রকৃতও হতে পারে, আরোপিতও হতে পারে)। বাংলাদেশের গান নিয়ে এই ছোটো আলোচনাটির মধ্যেই খানিকটা দেখাতে চেষ্টা করেছি, যে বিশেষ কিছু আঙ্গিক থেকে পর্যবেক্ষণ করলে গানের একটি স্বতন্ত্র যাত্রা বা চরিত্র ফুটে উঠতে পারে। এর পরের অংশে আলোচনা করবো লেখার শুরুতে উল্লেখ করা তিনটি আঙ্গিক থেকে নব্বইয়ের দশকের পরবর্তী বাংলা গান নিয়ে। আমার আশা এবং বিশ্বাস, এতে বর্তমান বাংলা গানের একটি জিনিয়লজি (genealogy) পেলেও পেতে পারি।
বাংলা গানের পথের সন্ধান- দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রাসঙ্গিকতা, সাংস্কৃতিক লেন-দেন, শ্রেণীচরিত্র
আধুনিক বাংলা গানের ইতিহাস এক বিরাট সমুদ্রের মত। সে সমুদ্রের ঢেউ বর্তমানে কোন দিকে চলেছে, তার হদিস পেতে গেলে এই ইতিহাসকে জিনিয়লজির রূপে চেনার চেষ্টা করাই ভালো। ইতিহাস এবং জিনিয়লজির বিষয়ে কিছু শিক্ষা ধার নিচ্ছি ফরাসী তাত্ত্বিক মিশেল ফুকোর থেকে। ফুকোর মতে, আমরা ইতিহাস বলতে মনে করি অতীতের নির্দিষ্ট কিছু তত্ত্ব বা কিছু বস্তুকে চেনার বিজ্ঞান। আদতে তা নয়। ইতিহাসকে জিনিয়লজি বা বংশ-পরিপ্রেক্ষিত হিসেবে দেখলে আমরা টের পাবো, কোন আঙ্গিক থেকে ইতিহাসকে আমরা দেখছি, তার উপর বেশী জোর দিলেই বরং সেই ইতিহাসকে উৎপাদনশীলভাবে জানা যায়, এবং বর্তমানের সঙ্গে তার যোগসূত্রের সন্ধান মেলে। আমার এই আলোচনাতেও তাই তিনটি আঙ্গিক বা তিনটি প্রশ্নের সাহায্যে থেকে বর্তমান বাংলা গানের কিছু বৈশিষ্ট আমি দেখার চেষ্টা করবো-বর্তমান বাংলা গান কি প্রাসঙ্গিক? বর্তমান বাংলা গান কি বিদেশী সংস্কৃতির থেকে উদারভাবে গ্রহণ করতে পারছে? বর্তমান বাংলা গানের কি একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীচরিত্র এবং বেঁচে থাকার লড়াই আছে?
প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্ন দিয়েই শুরু করি। খুব সহজ ভাষায় বলতে গেলে, যে গান তার নিজের সময়ের কথা বলছে, বা তার নিজের যুগের চরিত্রগুলোকে প্রকাশ করার উপযোগী ভাষ্য তৈরী করতে সক্ষম হচ্ছে, সেই গানই প্রাসঙ্গিক গান। এই বিচারের একটা বড় অংশ নিঃসন্দেহে করা যায়সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তব নিয়ে গান তৈরী করার নিরিখে; যে গান তার নিজের জগতের সমাজ-রাজনীতির থেকে বিচ্ছিন্ন, সে গান প্রাসঙ্গিক বা বাস্তব-সচেতন নয়। বাংলা ভাষায় গণসঙ্গীত বা রাজনৈতিক বক্তব্যের মাধ্যম হিসেবে তৈরী হওয়া গানের ইতিহাস অনেকদিনের, তাতে হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, ফকির আলমগীর, বা ভূপেন হাজারিকার মত কিংবদন্তীদের নাম উঠে আসে। নব্বইয়ের দশকে এপার বাংলায় কবীর সুমন বা নচিকেতা চক্রবর্তীর মত শিল্পীরাও প্রয়োজনে এই ধারার সাহায্য নিয়েছেন। জনমানসে এই ধারার গানের যে প্রতিষ্ঠিত শিল্পসমষ্টি বা ক্যানন (canon), তা নিয়ে আলোচনায় কিন্তু একটু ব্রাত্য থেকে গিয়েছে আধুনিক বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীত, বিশেষ করে রক সঙ্গীত। অথচ আমার মতে এর উল্টোটাই হবার কথা ছিলো, কারণ রক সঙ্গীত (বা তার আদি জনক, ব্লুজ সঙ্গীত) কিন্তু আদতে উঠে এসেছে তীব্র রাজনৈতিক উচ্চারণ থেকেই।
আমরা যারা কৈশোরে বাংলা রক ব্যান্ডের উত্থান দেখেছি, আমাদের মনে থাকার কথা ২০০৫ সালে ক্যাকটাস ব্যান্ডের যুদ্ধবিরোধী গান “বুদ্ধ হেসেছে”-র লিরিক; “ধর্ম খোঁজে অন্ধ/ অস্ত্র খোঁজে দ্বন্দ/ সীমান্ত বন্ধ, তবু খবর আসবেই।“ আবার এর ঠিক দু’ বছর পরে, পৃথিবী ব্যান্ডের “বারুদ” এলবামের টাইটেল ট্র্যাকে পাচ্ছি এর চেয়েও স্পষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্য, যে ভাষ্য বলছে সংসদীয় রাজনীতিকে ত্যাগ করে বিপ্লবের পথ বেছে নেবার কথা- “আমার শিরায় শিরায় রক্তের মিছিল/সংশয় এই প্রাণে/যত নির্বাচন আজ ভাগাড়ে যাক/আমি জন্ম নেবো আগুনে।“ এমন উদাহরণ প্রচুর পাওয়া যায়। ফসিলসের “মিলেনিয়াম” গানের শেষে রসিকতা করে বলা হচ্ছে, শতাব্দীর শেষে পৃথিবীতে মহাপ্রলয় এলো না কেন? ঈশ্বর বোধহয় মানুষের হাতে নিউক্লিয়ার অস্ত্র দেখে ঘাবড়ে গিয়েছেন! প্রাচীর ব্যান্ডের “ভারতবর্ষ” গানে শ্রমজীবী রাজনীতির কথা শুনতে পাই (“এখানে যে কষ্ট করে, কেষ্ট তারই/ একা মরে অর্ধাহারী”), আবার জতুগৃহ ব্যান্ডের “ফিরে এসো অর্জুন” গানটি দুষ্কৃতিদের গুলিতে অর্জুন সেন নামে একজন বাস চালকের হত্যার খবরকে তুলে ধরে। এ ধরণের উচ্চারণকে কিন্তু নিছক শখ বা ট্রেন্ড বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, এর পিছনে রয়েছে বাংলা রক সঙ্গীতে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক চর্চা। সে চর্চা দেখা যায় নব্বইয়ের দশকের গোড়াতেই ম্যাকের গানে, যেখানে তিনি সরাসরি দাবী রাখছেন, রাষ্ট্র যদি নাগরিককে চাকরির নিরাপত্তাটুকু না দিতে পারে, তবে সে যেন তাকে আইনের পথে থাকার ফাঁকা উপদেশও না দেয়- “চাকরি দে/ নইলে মোদের অসৎ পথে বেঁচে থাকবার অধিকারটুকু দে।“ অথবা আরো আগে, মহীনের ঘোড়াগুলির “শোনো সুধীজন” বা “এই মুহূর্তে”-র মত গানেও আমরা স্পষ্টতই পাচ্ছি রাজনৈতিক উচ্চারণ, যেখানে তাঁরা নিজেরাই জানাচ্ছেন, চারপাশের অবস্থা দেখে তাঁদের গান গাইবার খুব প্রয়োজন, কারণ “এ বিশ্বরূপ দেখে চুপ করে থাকি যদি/ আমি নেহাতই বেহায়া!” ব্যান্ডের গানকে ব্রাত্য রেখে তাকে “সিরিয়াস” রাজনৈতিক গান বা প্রতিবাদী গানের বিশুদ্ধ মঞ্চ থেকে বাদ দেবার যে প্রবণতা, তার প্রতিরোধে এই সিরিয়াস রাজনৈতিক চর্চার ইতিহাসটুকুও মনে রাখা প্রয়োজন। যে ইতিহাসকে বর্তমানেও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সমসাময়িক ব্যান্ডের গান- ব্লাড ব্যান্ডের “সর্বহারা,” বা আমার ব্যান্ড/ডুও কবীর ন শিবা’র “বৈষম্য ব্লুজ” তার উদাহরণ।
এই চর্চা কিন্তু কেবল ব্যান্ডের শিল্পী ন’ন, একক শিল্পী বা গান-লিখিয়েদের মধ্যেও লক্ষ্য করা যায়। সমকালীন যুগের রাজনীতি এবং প্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক তর্কবিতর্কের থেকে এ যুগের বাংলা গান-বাঁধিয়েরা বিচ্ছিন্ন হয়ে তো পড়েনই নি, বরং এ তর্কের সঙ্গে আরো বেশী করে যুক্ত হতে একরকম বাধ্যই হয়েছেন, কারণ বিগত দশ বছরে বা তারও কিছু বেশী সময় ধরে সারা পৃথিবীতেই কিছু বিপুল রাজনৈতিক পরিবর্তন এসেছে। একাধিক দেশে উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান, নব্যউদার পুঁজিবাদের হাত ধরে বিশ্বায়নের বাড়বাড়ন্ত, আমাদের দেশে বেসরকারীকরণ এবং ধর্মীয় মৌলবাদের দ্বৈত উৎপাত, এবং অবশ্যই গত দু’ বছর ধরে কোভিড অতিমারী এবং তার ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক পরিণাম। এ হেন জগতে গান গাইতে গেলে বর্তমান সামাজিক-রাজনৈতিক বক্তব্যকে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া চলে না। ফলে গান-বাঁধিয়েদের মধ্যে অনেকেই গানকে তাঁদের স্ব স্ব অবস্থানের রাজনৈতিক বক্তব্যের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। যেমন, বাংলাদেশের একজন খুব গুরুত্বপূর্ণ গীতিকার-গায়ক কফিল আহমেদ নিজের দীর্ঘদিনের কমিউনিস্ট রাজনীতি এবং একটিভিজমের মাধ্যম হিসেবে ব্যাবহার করছেন তাঁর নিজস্ব ধারার গানকেই। তাঁর গানে তিনি মূলত ব্যাবহার করেন প্রকৃতির রূপক- পাখির ডানা, গোরুর চোখ, এমন দৈনন্দিন প্রাকৃতিক ছবিকে একটি বৃহত্তর চিন্তার রূপ দিয়ে তিনি একের পর এক প্রতিবাদী গান বেঁধে গিয়েছেন। তাঁর লেখা “মাসানুবো ফুকুয়োকা” বা “শ্মশানে কবরে ঘুম জাগাও জাগাও”-এর মত বিমূর্ত ধারার গান তাঁকে মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রোতাদের কাছে একধরণের কাল্ট হিরো করে তুলেছে, এবং এই অনুরাগ-শ্রদ্ধার অনেকটাই তিনি পেয়েছেন তাঁর রাজনৈতিক, প্রতিবাদী চেতনার গানের নিরিখে। আবার এপার বাংলায় যখন কোভিড অতিমারীর সময়ে সিপিআই(এম) পার্টির উদ্যোগে পাড়ায় পাড়ায় শ্রমজীবী ক্যান্টিন চালু হয়, তখন সেই ক্যান্টিন নিয়ে পার্টির সাংস্কৃতিক কর্মী এবং গীতিকার আকাশ চক্রবর্তীর গান বিপুল সমাদর এবং জনপ্রিয়তা পায়- “এই যৌথ হেঁসেল পাঠায় ডাক/ খাওয়া-খাওয়ির খেলা নিপাত যাক/ আমার দেশে, সবার দেশ, সব মানুষই যত্নে থাক/ গরম ভাতের গন্ধে থাক।“দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ন’ন, এমন গীতিকারেরাও তাঁদের গানে রাজনৈতিক বাস্তবকে এড়িয়ে যান নি। রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যার পরে রূপম ইসলাম তাঁকে নিয়ে “মনে রেখো যে রক্তে রোহিত-কণিকা আছে/ সে রক্ত নুন খায় আমার স্বদেশ”-এর মত লিরিক লিখে হিন্দুত্ববাদীদের রোষের শিকারও হয়েছেন। অতএব দেখা যাচ্ছে, বর্তমান গান-বাঁধিয়েরা তাঁদের শিল্প সৃষ্টি করার পথে বাস্তবের থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে গজদন্তের মিনারের আরাম খুঁজে নিচ্ছেন না, বরং যুগের ব্যাপারে সচেতন করার যথেষ্ট চেষ্টা করছেন শ্রোতাদের। এবং সে বিষয়ে সফলও হচ্ছেন।
শুধু সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়ে গান লেখা দিয়েই প্রাসঙ্গিকতার বিচার অবশ্য করছি না। গানকে প্রাসঙ্গিক হতে গেলে তার যুগের গোটা চেতনাকে, তার দৈনন্দিন বাস্তবের খুঁটিনাটি আবেগের ভাষাকে নিজের ভাষ্যে প্রকাশ করার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিক থেকে যে বাংলা গান তৈরী হচ্ছে, তার একটা বড় অংশকে কিন্তু এ বিষয়ে যথেষ্ট সফল বলতে হবে, কারণ শতাব্দীর শুরু বা “turn of the century”-তে শহর-মফস্বলের বাঙালী নবীন সমাজের মূল চেতনাকে এ সময়ের গান খুব কাছ থেকে চিনতে পেরেছে। নব্যউদার পুঁজিবাদের উত্থানের পর থেকে গোটা পৃথিবীর তরুণ সমাজকে, অর্থাৎ মূলত ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের, এক ভয়ঙ্কর একাকিত্ব এবং অবসাদ গ্রাস করতে শুরু করে। মনস্তাত্বিক জেফ সুগারম্যানের মতে, “নব্যউদার রাজনীতি মূলত পণ্যীকরণের পুঁজিবাদের (consumer capitalism) মাধ্যমে মানুষে মানুষে যে স্বাভাবিক, সামাজিক যোগাযোগ, তাকে বিচ্ছিন্ন করে তার বিকল্প হিসেবে তুলে ধরে ভোগবাদকে। ফলে যত দিন যায়, মানুষ একে অপরের থেকে আরো বেশী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, এর ছাপ স্পষ্ট ফুটে ওঠে আধুনিক পৃথিবীতে মহামারীর আকার ধারণ করে মানসিক অবসাদে।“ নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে বাঙালী সমাজও এই অসুখের নজর এড়াতে পারে নি। নবীন সমাজ যখন তাদের এই একাকিত্ব, অবসাদ, উত্তর-ইন্টারনেট যুগের বিচ্ছিন্নতা এবং রাগ প্রকাশ করার ভাষা খুঁজছে, তখন সেই ভাষা তাদের কাছে পৌঁছে দেয় বাংলা রক সঙ্গীত এবং তৎকালীন সিঙ্গার-সংরাইটাররাই। তার আগেও মূলধারার গানে প্রতিবাদ বা রাগের ভাষ্য আমরা পেয়েছি, কিন্তু যে অস্তিত্ববাদী অস্থিরতা (angst) বা রাগে ফেটে পড়ার ভাষা এই প্রজন্মের দরকার ছিলো, তা রক সঙ্গীত ছাড়া তাঁরা এত সহজে পেতেন বলে মনে হয় না। ফসিলসের “নেমেসিস,” “একলা ঘর” বা “বাইসাইকেল চোর,” লক্ষ্মীছাড়ার “জীবন চাইছে” বা “গ্লিসারিন,” ক্যাকটাসের “রাজার রাজা,” ইনসমনিয়ার “প্রলয়ের সময়ে,” এলিয়েনসের “হেরোদের খাতায়,” ওপার বাংলায় শিরোনামহীন ব্যান্ডের “জাহাজি” বা “নিশ্চুপ আঁধারে” (গীতিকার জিয়াউর রহমান)- এ ধারার গান মূলত যে বাঁকবদলটা এনে দিলো, সেটা একটা পাল্টে যাওয়া দুনিয়ার এবং চেতনার মতপ্রকাশের ভাষ্য তৈরী করার আন্দোলন। তার মধ্যে অসম্ভব রাগ এবং বিরক্তি ছিলো, আত্মবিশ্লেষণ এবং নিজেকে নিয়ে তিক্ততা-অস্থিরতা ছিলো, একাধারে একাকিত্বের উদযাপন এবং তার চার দেয়ালে বাঁধা পড়ে যাবার হতাশা ছিলো, ছিলো অহঙ্কার এবং আত্মবিশ্বাসের অভাবের আশ্চর্য দোলাচল। পাশাপাশি এ সব গানের ভাষ্যে গালাগালি বা কটু ভাষ্যের সাবলীল প্রবেশ ঘটেছিলো, যা ভদ্রলোকী শালীনতাকে খানিকটা চ্যালেঞ্জ করেই ভাষার সীমারেখাটাকে ধাক্কা দিতে সক্ষম হয়েছিলো, যেমন দিয়েছিলেন ১৯শ শতাব্দীতে বিখ্যাত ইংরেজ কবি রবার্ট ব্রাউনিং। আর হ্যাঁ, এর পাশাপাশি ছিলো বাংলা গানে প্রেম নিয়ে লেখার একটা সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিক। প্রেমের মধ্যে হয় পরিপূর্ণতা নয় অভিমান, এই বাইনারি ভেঙে এর পাশাপাশি প্রেমেও যে চরম রাগ, বিরক্তি, হিংসা, কূটনীতি থাকতে পারে, তা কিন্তু এই সময়ের গান চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। না হলে কি “উফ কতদিন তোমাকে দেখিনি/ দেখতেও চাইনা এ কথা মিথ্যে নয়”-র মত নিষ্ঠুর সত্যি কথা এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে, যে প্রকাশ হবার প্রায় কুড়ি বছর পরেও সে গানের লাইন অকাতরেই সমকালীন কিশোরদেরও প্রেম ভেঙে যাবার পাথেয় হয়ে উঠছে?
এর সবটাই কি অত্যন্ত উচ্চমানের ছিলো? এর মধ্যে কি পরিশীলনের অভাব বা কাঁচা কাজ ছিলো না? অবশ্যই ছিলো। তবে সেটা ছিলো বয়সের নিয়মেই। এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ভাষ্য কিন্তু থেমে থাকে নি, শ্রোতাদের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গেই তার বিবর্তন ঘটেছে ডারউইনের নিয়ম অনুযায়ী। এ বিষয়ে এপার বাংলার সম্ভবত সবচেয়ে সফল শিল্পী রূপম ইসলাম। তাঁর লেখনী তাঁর শ্রোতাদের সঙ্গে সঙ্গেই বয়সে বেড়েছে, এবং নিত্য নতুন ভাবনাকে নিয়ে এসেছে গানের পরিসরে। ফসিলসের প্রথম এলবামের “তোকে ভেবে আগে কাঁদতাম/আজকাল কাঁদতে পারি না” গোত্রের কাঁচা বয়সের অভিমান বা রাগ থেকে তাঁর লিরিক এসে পৌঁছোয় তাঁর একক এলবামের “তুমিও ঠিক, আমিও ঠিক/ ভুল নিতান্তই প্রাকৃতিক”-এর মত আশ্চর্য উপলব্ধিতে। এবং আবার বলি, এই যে নতুন ভাবে দুনিয়াকে দেখার চেষ্টা এবং সেই ভাষাকে গানে নিয়ে আসার বাঁকবদল, এর’ও কিন্তু দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে বাংলা ব্যান্ডেরই ইতিহাসে। মহীনের ঘোড়াগুলির “পৃথিবীটা নাকি” বা গড়ের মাঠের “তোমায় দিলাম” গানগুলি এর উদাহরণ, এবং এ উদাহরণগুলো বিপুল জনপ্রিয়। তবে তুলনামুলকভাবে এঁদের একটু কম পরিচিত গানেও কিন্তু জীবনবোধ এবং চেতনাকে ফুটিয়ে তোলার এই পরিশীলন পাওয়া যায়। সত্তরের দশকে প্রকাশিত মহীনের ঘোড়াগুলির এলবাম “অ উ ব”-র টাইটেল ট্র্যাকে আমরা পাই এই আশ্চর্য জীবনবোধের খোঁজ- “রাত কি বা, কি বা দিন, ঘেমো ঘরে আলোহীন/ ভৌতিক কেরানিরা রই/ আবছায়ে নড়ি চড়ি, থুতনিতে রুখু দাড়ি/ এই কোলাহলে নিরজন।“ নব্বইয়ের দশকে হৈ হৈ করে ‘জীবনমুখী’ গানের জন্মলগ্ন যাঁরা পালন করেন, তাঁরা কিন্তু একটু আমতা আমতা করেই ব্যান্ড সংস্কৃতিতে অনেকদিন আগেই এমন বাস্তববাদী জীবনবোধ, রসিকতা, এবং কাব্যিক ভাষ্যের এই মেলবন্ধন এড়িয়ে যান।
প্রাসঙ্গিকতার কথা ভাবতে গিয়ে যে গানটির কথা মনে পড়ছে, সেটিকে এই অংশের শেষ উদাহরণ দিয়ে ইতি টানি। উত্তর-ইন্টারনেট প্রজন্মের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গেছে যে জিনিসটি, যে জিনিস আগের প্রজন্মের কাছে প্রাসঙ্গিক নয়, এবং আগের গানেও তার কথা আসে নি, তা হচ্ছে ভিডিও গেম। এই ভিডিও গেম যে কত সাবলীলভাবে গানের আখরে ঢুকে এসেছে, তার একটি উদাহরণ লক্ষ্মীছাড়ার “কে কী বলে গেলো” গানের মিউজিক ভিডিও। এই ভিডিওতে (সেই সময়কার নিরিখে খুব নিম্নমানের নয়) গ্রাফিক্স ব্যাবহার করে দেখানো হয়েছে, ব্যান্ডের সদস্যরা এই গান গাইতে গাইতে কাউন্টার স্ট্রাইক বলে একটি বিখ্যাত যুদ্ধের ভিডিও গেমের চরিত্র হয়ে উঠেছেন। ঐ গেমের মধ্যে বন্দুক হাতে দৌড়োদৌড়ি করছেন গাবু, নীলাঞ্জন, শুভজিত, গুলি চালাচ্ছেনশত্রুকে লক্ষ্য করে, হেঁট করে গুলির হাত থেকে প্রাণ বাঁচাচ্ছেন। আধুনিক জীবনের একটি সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিককে যে এত সহজে গানের দৃশ্যপটে গ্রহণ করে নেওয়া যায়, তা ঐ ভিডিওটি দেখে আমরা অনেকেই শিখেছিলাম। প্রাসঙ্গিকতার হিসেব যদি আধুনিক জীবনের সঙ্গে গানের বিবর্তন এবং নতুন ভাষার খোঁজের মাধ্যমে করতে হয়, তবে এ যুগের গানকে অপ্রাসঙ্গিক বলা চলে না।
গ্রহণ করার কথায় কথায় আসি দ্বিতীয় প্রসঙ্গে- বিদেশী সংস্কৃতিকে নিজের শিল্পে গ্রহণ করার উদারতা এবং তাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর ক্ষমতা। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য শিরোধার্য- পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ধারকেরা বহুদিন ধরে আমাদের দেশ শাসন করেছেন, আমরা কি পাষাণ না বর্বর, যে তাঁদের সংস্কৃতির শিল্পকে গ্রহণ করবো না? আশ্চর্যভাবে, এই উক্তিকে যাঁরা সেলিব্রেট করেন ২০শ শতাব্দীর গানে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মেলবন্ধনের কথা বলে, তাঁরাই আকারে-ঈঙ্গিতে জানাতে ভোলেন না, “বাংলায় রক বলে কিছু হয় না,” সবই অপসংস্কৃতি, সবই বর্জ্য।মাঝে মাঝে মনে হয়, এঁরা কি আদৌ রক সঙ্গীত শুনে এই মন্তব্য করছেন? না কি পুরোটাই পরশ্রীকাতরতা? কারণ পাশ্চাত্য সঙ্গীতের নানা আঙ্গিককে সাদরে গ্রহণ করে বাংলা ব্যান্ড বা বর্তমানের শিল্পীরা যে চমৎকার গান তৈরী করেছেন, আমার বিশ্বাস তা শুনলে “কতবার ভেবেছিনু” বা “মনে রবে কি না রবে আমারে” গানের সংরাইটার-সুরকার রবীন্দ্রনাথ খুশীই হতেন। পাঠকদের খুব বেশী জ্বালাবো না, কেবল দু’টি উদাহরণ দিলেই আমার এই বক্তব্যটিকে একটু সাজিয়ে বলা যাবে- কীবোর্ডের ব্যাবহার, এবং গানের “ব্রিজ” বা সেতুরূপী অঙ্গ।
কীবোর্ড যন্ত্রটি বহুদিন ধরেই বাংলা গানে ব্যাবহৃত হয়েছে, সলিল চৌধুরী থেকে কবীর সুমন, বহু শিল্পীই এই যন্ত্রকে ব্যাবহার করে নিয়েছেন নিজেদের মত করে। তবে নব্বইয়ের ঐ বাঁকবদলের সময়ে মূলত ব্যান্ড সঙ্গীতের হাত ধরে কীবোর্ড আচমকাই এক নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করলো- একটি গোটা ব্যান্ড বা গানের দলেরসাঙ্গীতিক শিরদাঁড়া হিসেবে। এর পিছনে নিঃসন্দেহে ছিলো ইংরেজি রক সঙ্গীতে কীবোর্ডবাদকদের প্রভাব- জন লর্ড, রে ম্যানজারেক, রিচার্ড রাইট বা জর্ডন রুডেসের মত কীবোর্ড শিল্পীদের মাহাত্ম্যই ছিলো, তাঁরা নানারকম সুরের প্রলেপ বা “লেয়ার” (layer) ব্যাবহার করে একটি গানকে ভরাট এবং শ্রুতিমধুর করে তুলতে সক্ষম ছিলেন। একটি গানে কণ্ঠ-গীটার-ড্রামের পিছনে একজন কীবোর্ডবাদকেরই ক্ষমতা ছিলো একের পর এক প্রলেপ সাজিয়ে গানের খোলনলচে পালটে দেওয়া। মনে আছে, আমার নিজের এককালীন ব্যান্ড ইক্যুইলিব্রিয়ামের প্রথমদিকে একজন বেসবাদক ছিলেন, যিনি স্টেজে মাঝে মাঝে ঘাবড়ে গিয়ে ভুল বাজাতেন। সেই সময়ে আমাদের কীবোর্ডবাদক অভিনব চ্যাটার্জী যেভাবে ডান হাতে সুর বাজিয়ে বাঁ হাতে অন্য একটি স্বরে বেসের ঠেকা দিতেন, তাতে অভিজ্ঞ শ্রোতা না হলে ধরা মুশকিল ছিলো, কোথাও ভুল হয়েছে! কীবোর্ডবাদকের এই যে বিপুল ক্ষমতা, এই শিক্ষা পাশ্চাত্য সঙ্গীত থেকে বাংলা গানে নিয়ে আসায় যে ধারাবদল হ’লো, তা অকল্পনীয়। রাতারাতি কিছু গানের দলের সাঙ্গীতিক চরিত্র পালটে গেলো স্রেফ কীবোর্ডের মাহাত্ম্যে। এমন কি, শুধুমাত্র কীবোর্ডবাদক কী ধরণের বাজনা বাজাবেন, তার উপর নির্ভর করে গোটা ব্যান্ডের শব্দটাই পালটে গেলো, এর উদাহরণও রয়েছে। ক্যাকটাসের প্রথম এলবামে “হলুদ পাখি” বা “তুমিও বোঝো আমিও বুঝি”-র যে আপাদমস্তক পপ চরিত্র, তা সম্পূর্ণ পালটে গেলো দ্বিতীয় এলবামের “রাজার রাজা” বা “উড়ানের গান”-এর মত রক অঙ্গের গানে। এর কারণ? পপ ধারার কীবোর্ডবাদক কনিষ্ক বা “পিঙ্কি”র দল ছেড়ে দেওয়া, এবং রক-শিক্ষিত কীবোর্ডবাদক সুদীপ্ত বা “বুটি”র দলে প্রবেশ। আধুনিক যুগে যে বাংলার সুরকার বা সঙ্গীতায়োজকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কয়েকজন এই পাশ্চাত্য ধারায় প্রশিক্ষিত কীবোর্ডবাদক, এ জিনিস কাকতালীয় নয়। ইন্দ্রজিৎ দে, নবারুণ বোস, স্যাভি, তমাল কান্তি হালদার, শিবাশিস ব্যানার্জী- এঁদের সবারই সাফল্যের পিছনে রয়েছে বাংলা আধুনিক গানের পাশ্চাত্য কীবোর্ডশিল্পকে আপন করে নেবার ইতিহাস। কীবোর্ডের ব্যাবহার যে একটি গোটা গানের শিরদাঁড়া কীভাবে বেঁধে দিতে পারে, তা শুনতে চাইলে শুনে নিতে পারেন তমাল কান্তি হালদারের “আলোয় ভালোয়” বা “জোকার,” অথবা শিবাশিস ব্যানার্জীর “তোমার সঙ্গে,” “জোট বাঁধার গান” অথবা “শহরে একুশ।“সত্তরের দশকের পরে (তার আগে যন্ত্রানুসঙ্গের একটি স্বতন্ত্র ধারা ছিলো) যন্ত্রানুষঙ্গের ক্ষেত্রে বাংলা গান যে প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে এই যুগের ধর্মেই, তা অতি বড় অতীতপন্থীরও অস্বীকার করতে কষ্ট হবে।
ব্রিজ জিনিসটি আরো বৈপ্লবিক, তা একাধারে আধুনিক বাংলা গানের কাঠামো বা স্ট্রাকচারকে পালটে ফেলার রাস্তা দিয়েছে, এবং শিল্পীর হাতে তুলে দিয়েছে সেই গঠনটিকে ব্যাবহার করে গানের বিষয়বস্তুকে আরো বহুমাত্রিক করে তোলার। ব্রিজের কথা বলতে গিয়ে সমসাময়িক বাংলা গানের ব্যাপারে কিছু সনাতনী শিল্পীদের একটি অভিযোগের কথা না বলে পারছি না। কিছুদিন হ’লো কানে আসছে, কারোর কারোর মতে নাকি আধুনিক গানের শিল্পীরা সঞ্চারী বানাতে জানেন না। শুধু ভার্স, তারপর কোরাস, আবার সেই একই ভার্স- এই সুরের একঘেয়েমি শুনে শুনে তাঁদের নাকি বড়ই কষ্ট হচ্ছে। এ অভিযোগ শুধু অন্যায়ই নয়, অবাস্তব। কারণ ভার্স (মূল সুর, যে সুর গেয়ে গায়ক গানে ঢুকছেন) এবং কোরাস (বৃন্দগানের অংশ, যে অংশটি বারবার গানে ফিরে আসে), এই দুই সুর ভেঙে বেরিয়ে গানের মধ্যে বৈচিত্র্য আনা এবং এক অংশের সঙ্গে আর এক অংশের সেতুবন্ধনই ব্রিজের কাজ। ব্রিজ জিনিসটা পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অবদান, যেমন সোনাটা বা ফ্যুগ গোত্রের গানের একটি থীম বা বিষয়মূলক অংশ থেকে আর একটি থীমে যাবার সেতু হিসেবে তাকে ব্যাবহার করা হয় (আগ্রহী পাঠকেরা বাখের বিখ্যাত জি মেজর স্কেলে ফ্যুগে ব্রিজের ব্যাবহার শুনতে পাবেন)। এই ব্রিজ জিনিসটিকে পাশ্চাত্যের ব্যান্ড সঙ্গীত সাদরে গ্রহণ করে নেয়, এবং তাকে নিজেদের গানে কাজে লাগায়। লেড জেপেলিন (“স্টেয়ারওয়ে টু হেভেন” এক বিখ্যাত উদাহরণ), নির্ভানা, গানস এন্ড রোজেস, ডেফ লেপার্ড, পিংক ফ্লয়েড, কিং ক্রিমসন- গুরুস্থানীয় সমস্ত ব্যান্ডরাই ব্রিজের ব্যাবহারে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্রিজকে ব্যাবহার করে গোটা গানটির তাল এবং সুর পালটে শ্রোতাদের চমক দিয়েছেন কোনো কোনো ব্যান্ড, যাঁদের মধ্যে সিস্টেম অফ আ ডাউন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ব্রিজ জিনিসটা এসে গানের কাঠামোকে এক ধাক্কায় একঘেয়েমির হাত থেকে বের করে আনলো।
এই ব্রিজের ব্যাবহারকে বাংলা গানে নিয়ে এসে ব্যান্ডের শিল্পীরা (এবং একক শিল্পীরাও) দু’টি বৈশিষ্ট নিয়ে এলেন তাঁদের কাজে। প্রথমত, সাবেকী মুখরা-অন্তরা-সঞ্চারীর প্যাটার্ন ব্যাবহার না করেও তার পূর্ণ বৈচিত্র্যকে তাঁরা পাশ্চাত্য ধারার বাংলা গানে ধরে ফেলতে পারলেন। গানের প্রথম অংশ যে ভার্স এবং কোরাসের সুর নিয়ে খেলা করে, তারপরেই ঐ ব্রিজ বা সেতুবন্ধনের অংশটি শ্রোতাকে একটু অন্য দিকেও নিয়ে যায়, আবার তাঁকে প্রথম সুরের মূর্ছনায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিতেও সাহায্য করে। উপরন্তু, ব্রিজ অংশের সুরকে ব্যাবহার করেই গীটারবাদক বা কীবোর্ডবাদক মূল গানের সুরের চার দেয়ালে বাঁধা না থেকে অন্যভাবে নিজেদের একক বাদ্য বা সোলোর ব্যাবহার করতে সক্ষম হ’ন। ফসিলস ব্যান্ডের বেশ কিছু গানে যেমন ব্রিজের অংশটি পুরোপুরিই গড়ে তোলা হয়েছে গীটারের বাজনার সাহায্যে। দ্বিতীয়ত, এই কাঠামো গীতিকারদেরও প্রশ্রয় দেয় ব্রিজকে ব্যাবহার করে গানের মূল বক্তব্যের থেকে একটু বেরিয়ে এসে আরো বহুমাত্রিক কিছু বিষয়বস্তু উপহার দেবার। খুব সহজ করে বলতে গেলে, ভার্সের কাজ হচ্ছে একটি কোনো ভাবনাকে আস্তে আস্তে প্রকাশ করার (“পৃথিবীটা নাকি ছোটো হতে হতে/ স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে/ ড্রয়িং রুমে রাখা বোকাবাক্সতে বন্দী”), তারপরে কোরাস সেই ভাবনাকে তার চূড়ান্ত উচ্চারণে নিয়ে যায় (“ভেবে দেখেছো কি, তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে” ইত্যাদি)। ফলে ভার্স-কোরাসের সূত্র আসলে একই গল্পের সুতোয় বাঁধা। ধরুন, শুধুমাত্র ভার্স-কোরাস ব্যাবহার করে একটি রাজনৈতিক গান লেখা হচ্ছে। তার প্রতিটি অংশের বিষয়বস্তু হতে পারে এইরকম।
ভার্স ১ (“চারদিকে বড্ড অন্যায়-অবিচার, পুলিশ ঘুষ নেয়, মন্ত্রীরা নিজেদের রাজা ভাবেন” ইত্যাদি) à কোরাস (“চলো একসঙ্গে নতুন পৃথিবী সাজাই”) à ভার্স ২ (ভার্স ১-এরই সুর, ফলে বিষয়বস্তুও এক, “সেদিন এক নবীন ছাত্রকে খুন করলো গুণ্ডারা, আমরা কেউ প্রতিবাদ করলাম না” ইত্যাদি) à কোরাস (“চলো একসঙ্গে নতুন পৃথিবী সাজাই”)
এই এপাশ-ওপাশ-আবার এপাশের মাঝখানে ব্রিজ এসে আচমকাই এই গল্পের থেকে সরে এসে বাড়তি কিছু ভাবনা বা গল্পের সুতো ধরিয়ে দেবার সুযোগ দেয়। এতে শিল্পী সুযোগ পান তাঁর গানের গল্পটিকে একমাত্রিক না করে ফেলে বৈচিত্র্যপূর্ণ করতে। ফলে গানটি এরকম হতে পারে।
ভার্স ১ (“চারদিকে বড্ড অন্যায়-অবিচার, পুলিশ ঘুষ নেয়, মন্ত্রীরা নিজেদের রাজা ভাবেন” ইত্যাদি) à কোরাস (“চলো একসঙ্গে নতুন পৃথিবী সাজাই”) à ভার্স ২ (“সেদিন এক নবীন ছাত্রকে খুন করলো গুণ্ডারা, আমরা কেউ প্রতিবাদ করলাম না” ইত্যাদি) à ব্রিজ (“আচ্ছা, এই যে রাজনৈতিক গান গাইছি, এতে কি কোনো লাভ হচ্ছে? গান গেয়ে কি কিছু পালটানো চলে? না কি এই গানটাই আসলে ফালতু?” à কোরাস (“চলো একসঙ্গে নতুন পৃথিবী সাজাই”)
আচমকাই একমাত্রিক ভাবনার মধ্যে একটা আত্মোপলব্ধির লিরিক নিয়ে এসে গানের ব্যাপ্তিটাকেই বাড়িয়ে দেওয়া গেলো ব্রিজের সাহায্যে। আচমকা চেনা সুর পাল্টে অচেনার দিকে নিয়ে গিয়ে এখানে শ্রোতাকেও বেশ মোচড় দিতে বাধ্য করা যায়।
একটি উদাহরণ দিই। ফসিলসের “এসিড” গানটি অত্যন্ত আগ্রাসী, তাতে ডিস্টর্শনের ব্যাবহার গুরুত্বপূর্ণ। রূপমও এই গানে একটি ঘষঘষে, প্রায় মেটাল-ঘেঁষা কণ্ঠ ব্যাবহার করে থাকেন। এই গানের প্রতিটি ভার্সই দিনবদলের কথা বলে, অচলায়তন নিয়ে রাগের কথা বলে (“জ্বলে যাক ইচ্ছেরা সাধু ও ভণ্ড” ইত্যাদি), এবং প্রতিটি কোরাসই অচলায়তন ভাঙার ডাক দিয়ে বলে, “পথ তো একটাই, এসিড ছোঁড়ো মুখে” (সমাজের মুখে এবং নিজেরই আয়নার মুখে, এ গানে রূপম কাউকে আক্রমণ করার ডাক দিচ্ছেন না!) আচমকাই সমস্ত আওয়াজ থেমে দিয়ে ডিস্টর্শন বাদ দিয়ে সুরেলা গীটারে একটি প্রায় ভৌতিক ব্রিজ বেজে ওঠে, এবং সেই ব্রিজে নিজের ঐ চিৎকৃত, ঘষঘষে গলা ত্যাগ করে আচমকাই রূপম খাদে গলা নামিয়ে গল্পটাকেই পালটে দেন- “মায়াবী দণ্ড আসলে বাদ্যযন্ত্র/ তাতেই লুকিয়ে রাখি গোপন মন্ত্র/ আদিম সে মন্ত্রের কলাকৌশলে/ ফিরে যেতে চাই ফের তৃণবল্কলে।“ গানের মধ্যে আচমকাই এই যে গল্পের মোড়বদল, এর মূলে আছে ব্রিজের ব্যাবহার। বস্তুৎ, ব্রিজের প্রসঙ্গ তোলায় রূপম ইসলাম আমাকে জানান, “আমার একেবারে গোড়ার দিকের কিছু গান যদি বাদ দিস, তবে কিন্তু ব্রিজ ছাড়া আমি গান প্রকাশই করি না। ফসিলসের গানে ব্রিজের ব্যাবহার প্রচুর। মহাকাশ, শয়তান, রেজোলিউশানস, গুরু, মৃত্যু- একের পর এক গানগুলোয় চোখ বোলালেই ব্রিজ সেকশন দেখতে পাবি।“ গানের মধ্যে ব্রিজ ঠিক কোথায় ঢুকবে, সে নিয়েও পরীক্ষা-নিরিক্ষা করেছেন ফসিলস। “বিষাক্ত মানুষ” গানের একদম শুরুতেই যে কথাগুলো ফ্রি-স্টাইলে গায়ক বলেন, যে অংশ বাংলা ব্যান্ডের অনুরাগীদের মুখে মুখে ফেরে, সেই “সে চেনালো আমাকে এ শহরের অলিগলি” অংশটি কিন্তু আসলে ব্রিজ হিসেবেই বাঁধা হয়েছিলো। এ গানের আনপ্লাগড রূপে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে বাংলা গানে ব্যাবহার করা, উপরন্তু তা নিয়ে নিয়মিত কাটাছেঁড়া করার মুনশিয়ানা দেখানো, এর কৃতিত্বকে কিন্তু ছোটো করা অনুচিত হবে।
পাশ্চাত্য-পাশ্চাত্য করছি বলেই পাঠকেরা যেন ধরে নেবেন না, আধুনিক বাংলা গানকে অতীতকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করে এগিয়ে চলার মত একমাত্রিক নিদান আমি দিচ্ছি। আদতে সে জিনিস হয়ও না, বর্তমানের জন্ম হয় অতীত এবং ভবিষ্যতের মেলবন্ধনের মাধ্যমেই। বাংলা গান কি অতীতের শিল্পীদের দ্বারা প্রভাবিত হয় নি? কবীর সুমনের গানকে পাথেয় করে নিজেদের গান বেঁধেছিলেন শান্তনু বিশ্বাস (ইনি চট্টগ্রামের একজন নাট্যকর্মী, গীটার এবং হারমোনিয়াম বাজিয়ে “চিরকুট” বা “বহমান”-এর মত গান তৈরী করেছেন), গান করেন শায়ান (ইনি ব্যাক্তিগতভাবে আমার অত্যন্ত প্রিয় গীতিকার-গায়িকা, বন্ধুরা অবশ্যই শুনবেন), গান বাঁধে মেঘদল (এঁরা গানের দল, গোষ্ঠীবদ্ধভাবেই গান করেন)। বাদ্যযন্ত্রের দিক থেকেও বাংলা গান অতীতের রসদ নিয়েছে, যেমন শিরোনামহীন বলে বাংলাদেশের ব্যান্ডটি সরোদের ব্যাবহার করে নিজেদের গানকে একটা চমৎকার জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন। আবার লিরিকের দিক থেকেও আর্টসেলের গীতিকার রুম্মান আহমেদ “অনিকেত প্রান্তর,” “শহিদ সরণী” বা “ধূসর সময়”-র মত গানে জীবনানন্দ দাশের প্রচ্ছন্ন প্রভাব রেখেছেন। কিন্তু অন্যদিকে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের থেকে ধার নিতেও বাংলার শিল্পীরা কার্পণ্য করেন নি। আর্টসেল, ব্ল্যাক, আত্মহত্যা প্রভৃতি ব্যান্ডেরা বাংলায় মেটালের মত ঘরানাকেও নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন, এবং তাকে একেবারেই আপন করে নিয়েছেন। বস্তুত, এ শিক্ষাও আমার প্রজন্ম অগ্রজদের থেকেই পেয়েছে। কবীর সুমন যখন “শেষ পিকাসো” (নীল ডায়মন্ডের ‘দ্যা লাস্ট পিকাসো’) বা “আমি যাকে ভালোবাসি” (ডিলানের ‘লাভ মাইনাস জিরো’) লিখছেন, বা অঞ্জন দত্ত যখন কোহেনের ‘সিস্টার্স অফ মার্সি’ গানের সুর থেকে “শুনতে কি চাও” ধার নিচ্ছেন, তাঁরা কি এই মেলবন্ধনের ইতিহাসকেই প্রশ্রয় দেন নি? প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন, বা অতীত-বর্তমানের ভারসাম্য বজায় রেখে নতুন শিল্পের সৃষ্টি করাই শিল্পীর স্বধর্ম।
স্বধর্মের কথাই যখন তুললাম, তখন শেষ যে আঙ্গিকের কথা বলে আমি এই আলোচনা শেষ করবো, তা শ্রেণীচরিত্রের আঙ্গিক। বাংলা গানের শ্রেণীচরিত্র বা আত্মপরিচয় একটা বিরাট জিনিস, সেটা নিয়ে যত মত, তত পথ। বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, বিভিন্ন মূল্যবোধ থেকে সেই পরিচয়কে চিহ্নিত করার চেষ্টা করতে পারেন। তাই সুবিধের জন্য “শ্রেণী” জিনিসটিকে যদি আদি মার্ক্সীয় তত্ত্বের সাহায্যেই চিনতে যাই, তবে শ্রেণীর মূল পরিচয় তার সংগ্রামে- কী ধরণের সমস্যা বা সংঘর্ষের মধ্যে থেকে বাংলা গান তৈরী করে নিচ্ছে তার বর্তমান আত্মপরিচয় এবং ভবিষ্যতের রসদ। আমি মূলত যে যুগের বাংলা গানের কথা আজ বললাম, যাকে এমন একটি দানবের মোকাবিলা করতে হয়েছে, যার অস্তিত্ব এর আগের প্রজন্মের গানের সময়ে ছিলো না। অতএব সে দানবের সঙ্গে তাঁদের লড়তেও হয়নি, অতএব লড়াইয়ের পদ্ধতি বলে কিছু উত্তরাধিকারসূত্রে তাঁদের আমাদের দিয়ে যাবার অবকাশও হয়নি। এ লড়াই একান্তই আমাদের নিজেদের লড়তে হচ্ছে। এই দানবটির নাম ইন্টারনেট। যদিও ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব জিনিসটি বেশ কিছুদিন হ’লো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে, মূলত ২০০২/২০০৩ সাল বা তার সামান্য আগে থেকে বাংলার শ্রোতারা (মূলত শহুরে শ্রোতাসমাজ) এই জিনিসটিকে ব্যাবহার করে দেশবিদেশের নামী-অনামী শিল্পীদের গানের সন্ধান করতে শুরু করেন। এর ফলে শুধু গানের চরিত্র বা গানের বাজার নয়, গান নিয়ে আমরা কীভাবে ভাবনাচিন্তা করি, তার গোটা খোলনলচেটাই পালটে গেলো। ইন্টারনেটের অবশ্যই একটা অতুলনীয় উপকার রয়েছে- এক ধরণের আশ্চর্য গণতন্ত্র। আমার গান সবাইকে শোনাতে হ’লে আমার আর দিনের পর দিন কোনো দয়ালু প্রয়োজকের অফিসে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য বসে থাকার প্রয়োজন নেই, টিভির চ্যানেল বা রেডিওতে আমার গান বাজানোর দরখাস্ত করার দরকার নেই। আমি নিজেই নিজের গান রেকর্ড করে ছেড়ে দিতে পারি ইন্টারনেটে। ঐ একই প্ল্যাটফর্মে একজন প্রবীন শিল্পী এবং আমি পাশাপাশিই আমাদের গান প্রকাশ করবো, অতএব শ্রোতাদের ভালো লেগে গেলে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির ক্ষমতা থাকবে না, আমার এই অধিকার কেড়ে নেয়। অন্তত খাতায় কলমে এটাই হওয়া উচিত ছিলো। তবে প্রকৃতির লীলায় ব্যাপারটা বেশ অন্যদিকে চলে গেলো। আগে নতুন গান শুনতে হলে আমাদের একটু কষ্ট করে ক্যাসেটের দোকানে বা জলসায় যেতে হ’তো, একে-ওকে জিজ্ঞেস করতে বের করতে হ’তো নতুন শিল্পীর সন্ধান, তারপর ক্যাসেট বাজিয়ে শোনা, সিডি কিনতে যাওয়া, অনেকদিনের পরিশ্রমে একজন শিল্পীর খোঁজ পেয়ে তাঁকে আবিষ্কার করার তৃপ্তি- গান শোনাটা এই সময়ে ছিলো সক্রিয় (active) কাজ। যে মুহূর্তে আমরা ঘরে বসে বিনামূল্যে প্রাচুর্য্য পেতে শুরু করলাম, একটি বোতামের চাপেই যেখানে দশ মিনিটের মধ্যে কেনিয়ার লোকসঙ্গীত বা রোমানিয়ান ভাষায় বিয়ের গানের মত বিরল শিল্পও এখন খুঁজে বার করে ফেলা যায়, আমাদের গান শোনাটা হয়ে উঠলো অনেকটা নিষ্ক্রিয় (passive)। শ্রম যেখানে কমে যায়, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহও কমতে বাধ্য। তার উপরে ইন্টারনেটের মাল্টিমিডিয়া বা বহু-মাধ্যম চরিত্র আধুনিক যুগে গানকে করে তুলেছে ভিডিও-নির্ভর। যে শিল্পীকে আগে শুধু নিজের পারদর্শিতার জায়গা, অর্থাৎ গান তৈরী করা নিয়েই মাথা ঘামাতে হ’তো, তাঁকে বাধ্য হয়েই ভাবতে হচ্ছে ভিডিও বানানোর কথা। ফলে খরচও বেশী, পরিশ্রমকেও বইয়ে দেওয়া হচ্ছে অন্য দিশায়। এবং শ্রোতাদের ক্ষেত্রেও এই প্রবণতা বিপজ্জনক, কারণ গান শোনা ছেড়ে আমরা এখন গান দেখতে চাই। এর মধ্যে একটু হলেও একরকমের বিপজ্জনক আলসেমি আছে।
জলে একটু রক্তের গন্ধ পেলেই যেমন হাঙর চলে আসে, এই আলসেমি এবং আরামের সন্ধান পেয়েই ইন্টারনেট মাধ্যমটিকে সেইভাবে কবজা করতে চলে এলো কর্পোরেট ব্যাবসা এবং প্রযোজকের সর্বগ্রাসী পুঁজি। ফলে গান তৈরীর পদ্ধতি বা দর্শনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো ফর্মুলা বা ট্রেন্ড। কী ধরণের গান একবার বাজারে ছেড়ে ভালো ফল পাওয়া গেছে, তা নিয়ে গবেষণা করে আগামী দশটি গানও ঐ ধাঁচেরই বানানোর নির্দেশ দেবার সংস্কৃতি যে কতভাবে বেসিক বাংলা গানের ক্ষতি করেছে, তা লিখতে গেলে আর একটি গোটা প্রবন্ধ লিখতে হয়! তবে কয়েকটি উদাহরণ আমাদের জানা। যেমন, রেডিও বা অনলাইন স্ট্রীমিং মাধ্যমে সিনেমার গানে প্রায় একরকমের জমিদারি, যা বেসিক গানকে শুধু কোনঠাসা করেই দিচ্ছে না, বেসিক গানের নির্মাতাদেরও আকারে-প্রকারে বাধ্য করছে “সিনেমার মত করে গান বানাতে।“ মধ্যমেধার বা নিম্নমানের গানের যেহেতু চট করে বাজারী হয়ে ওঠার ক্ষমতা আছে, সেহেতু সেই মাপের গান বাঁধাটাকেই অলিখিত নিয়ম করে দেবার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এপার বাংলার অনুপম রায়, বা ওপার বাংলার তাহশান বা বেসবাবা সুমনের মত শিল্পীদের তুমুল বাণিজ্যিক সাফল্য, এবং তার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁদের মত গান লিখতে চাওয়ার একটা বিপুল আগ্রহ এবং অনুরাগ, এর সবটাই কিন্তু বাঁধা রয়েছে ঐ ফর্মুলার গানের চরিত্রে। ফলে বাংলা গানের কোনো পথে এগোনোর প্রচেষ্টাকেই আটকে দেওয়া হচ্ছে বাঁধা ছকের চোখরাঙানিতে এবং পয়সার গা-জোয়ারিতে। “কাঁচা বাদাম,” “কোলাভারি ডি” বা “বোল না আন্টি আউঁ কেয়া”-র সাফল্যের যুগে স্বতন্ত্র বাংলা গানকেই তার নিজের সংকটের জন্য দায়ী করাটা অনেকটা প্রথম হাফেই মেসিকে ফাউল করে চোট পাইয়ে তারপর তিনি গোল কেন করতে পারেন নি বলে ভুরু কোঁচকানোর মত। অভূতপূর্ব বাণিজ্যিক এবং ইন্টারনেট-জনিত চাপের মধ্যে বাংলা গান যে মাটি কামড়ে পড়ে আছে, এটাই তো কৃতিত্বের কথা।
এবং শুধু পড়ে নেই, বাংলা গান কিন্তু লড়ছে। এবং এই লড়াই বা সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই ফুটে উঠছে তার আত্মপরিচয়, তার শ্রেণীচরিত্র। ছেলেমেয়েরা নিজেদের বাংলা গান লিখছেন, গাইছেন, বাজাচ্ছেন, রেকর্ড করছেন, ভিডিও তৈরী করছেন। মঞ্চ ছেড়ে রাস্তায় রাস্তায় বাস্কিং করা বা ছাদে ছাদে “রুফটপ” জলসার সংস্কৃতি এই প্রজন্ম নিয়ে এসেছে, কারণ সাবেকী পরিকাঠামোয় চাপে পড়ে তাকে একটু অন্যভাবে ভাবতে হচ্ছে নিজের গান পরিবেশন করার জন্য। এই যে সাবেকী ব্যাবস্থার চাপে নিজের রাস্তা নিজে তৈরী করে নেবার প্রক্রিয়া, এর একটি বিচিত্র উদাহরণ ব্যাঙ্গাত্মক সঙ্গীতশিল্পী রোদ্দুর রায়। তাঁর গানের গোটা চরিত্রটাই এই, যে তিনি ইচ্ছে করে ভায়োলিন বা উকুলেলে বেসুরে, বিকটভাবে বাজিয়ে, গালাগালি এবং মাদকদ্রব্যের উল্লেখে সমৃদ্ধ সঙ্গীত তৈরী করেন, বেসামালভাবে নাচেন, এবং ইচ্ছে করেই শ্রোতাদের বিরক্ত করে বা রাগিয়ে দেয় আনন্দ পান। অথচ ভদ্রলোকের লিরিক পড়লে বোঝা যায়, তিনি শুধু সুশিক্ষিতই ন’ন, সুরসিক। ইচ্ছে করেই তাঁর এই সাঙ্গীতিক যাত্রা, যা “অর্থহীন” বা “অবান্তর”-কে গানের আখরে নিয়ে আসতে চায়, একটু স্থূল হলেও এর পিছনে কিন্তু বিদ্রোহের বা প্রতিরোধের একটা আবেগ রয়েছে।
এবং রোদ্দুর রায়ের মত খামখেয়ালী শিল্পীই বলি, বা আর একটু মার্জিত শিল্পীদের কথাই বলি, তাঁদের সবারই গানের যাত্রাটা কিন্তু চলছে লড়াই করতে করতে। আসলে, একটি যুগের গান ঠিক কোন রাস্তায় চলেছে, তা ঠিক করে দেয় কেবল তার পরের যুগ। এইভাবেই ক্যানন (canon) তৈরী হয়। মেরি শেলীর লেখা উপন্যাস “ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন”-কে আজ সারা পৃথিবীর সাহিত্যিক সমাজ নতমস্তকে শ্রদ্ধা জানান হরর বা কল্পবিজ্ঞানের পথে অন্যতম প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে। কিন্তু শেলী যখন এই গল্প লিখেছিলেন, তখন তা কিন্তু অনেক দিন পর্যন্ত তাঁর ডাকসাইটে স্বামী, কবি পার্সি শেলীর কাব্যিক জিনিয়াসের আড়ালে ঢেকে রাখা হয়েছিলো। বইটিকে সেইভাবে তার প্রাপ্য সম্মান পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে পরের প্রজন্মের ফিরে দেখার। আজ বাংলা গানে যা কাজ হচ্ছে, তাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে একাধিক বিঘ্ন। তার একদিকে রয়েছে গানকে পণ্য বানানো উত্তর-ইন্টারনেট, উত্তর-স্ট্রীমিং প্রজন্মের ভয়ঙ্কর ক্ষমতাশালী কর্পোরেট পুঁজি। অন্যদিকে রয়েছে সনাতনী শিল্পীদের পদে পদে নবীন শিল্পীদের পিছনে লাগার সংস্কৃতি, যে সংস্কৃতি বাংলার শিল্পসমাজে আজকাল এতটাই অবিরল যে তাকে প্রায় ক্যারিকেচার বলে মনে হয়। আবার আর একদিকে রয়েছে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অভাব- বাংলা গান করে খাবে কি, এই প্রশ্ন বহু মেধাবী এবং কর্মনিষ্ঠ শিল্পীদেরই গান তৈরী করার থেকে অকাল-অবসর নিতে বাধ্য করছে (কলকাতায় ব্যান্ডের দুনিয়ায় একরকমের অম্লমধুর রসিকতায় টি সি এস বা কগনিজ্যান্টের মত কোম্পানিদের বলা হয় রক ব্যান্ডের যম- কারণ ব্যান্ডের শিল্পীরা না কি কিছুদিন বাজানোর পর উপার্জনের তাগিদে গীটার-ড্রামস শিকেয় তুলে এঁদের আপিসে ঢুকে পড়েন)। এই নানা বিঘ্নের মাঝখানে বাংলা গানের দইয়ের ভাঁড় হাতে জটিল কোথায় যাবে, তা বলতে পারার মত মধুসূদন দাদা রয়েছেন একমাত্র পরের প্রজন্মেই। ইতিহাস এর সঠিক হিসেব নেবে।
আমি সততই মনে করি, বাংলা গান তার নির্দিষ্ট পথেই চলেছে। তবে সেই পথ ঠিক না বেঠিক, মসৃণ না বন্ধুর, এই হিসেব দিতে পারে একমাত্র ভবিষ্যৎ। ততদিন তার চলার পথ সে নিজের খুঁজে নেবে, এবং নিত্য নতুন চমক উপহার দেবে শ্রোতাদের। তবে তার এই যাত্রা সনাতনী গোঁড়াদের ভালো না লাগতেও পারে। আসলে সবাই বিশ্বাস করতে চান, পথ আমাকে দিয়েই শেষ হয়ে গেছে, আমিই সর্বোচ্চ শিখরে এসে জয়পতাকা মেলে দিয়েছি। আমার পরে আবার পথ কি? আমার পরে পথ মানে আসলে বেপথে ঘুরতে যাওয়া।
পথ-বেপথের এই তর্ক থেকে বেরোতেই বোধহয় বছর চারেক আগে একটি আধুনিক বাংলা গান লিখেছিলাম। একটু নিজের ঢাক নিজেই পিটিয়ে লেখাটি শেষ করি- “যে পথে যাই আমি, আমি যাই ঘুরেফিরে/ সফরে সঙ্গী না, ভাবনার প্রয়োজন/ আমার পথ চলা আনন্দ এনে দিক/ আমার পথ চলা পথের বিজ্ঞাপন।“
প্রথম বর্ষ ✦ পঞ্চম সংখ্যা
‘কবিতা রচনা করতে পারি আর না-পারি, আশৈশব কবিতাকে নিবিড়ভাবে ভালোবেসে আসছি…। মানুষ যা হতে চায়
সেইটেই তো মানুষের সত্যকার পরিচয়।’
অনস্তিত্বের প্রকাশই থেকে যাওয়া। না হয়ে ওঠাই আসল হওয়ার সুত্র৷ কবিতাকে
তাই হতে হয় জীবন, জীবনের ‘রৌদ্রকরোজ্জ্বল কোলাহল’। যদিও, প্রত্যাখ্যান ছাড়া কিছু নেই, তবুও,
বিস্তীর্ণ নৈশব্দে এটাই তো সত্য। সত্য যা, তা কখনো বঞ্চনা করে না। জীবনে যা যা ঘটে
সবই সত্য, যেগুলো ঘটল না কিন্তু ঘটলে ভালো হত বলে ভাবা হয়, সেগুলোও কম সত্য নয়। পরিপূর্ণ
হয়ে ওঠা একপ্রকার নিঃস্ব হয়ে ওঠাই তো। আছি, এই না থাকার মধ্যে দিয়ে আছি, নিজের অনস্তিত্বকে
প্রমাণ করতে করতেই একজন ‘নিশীথ-বিলাসী’ কবি হয়ে ওঠেন-- একজন স্বপ্নবর্ণিক কবি।
‘আমার প্রথম ভয় পাওয়ার
কথা লিখে রাখছি। আরো অনেক ভয় আছে, তাদের কথা পরে লিখবো। অনেক ভয় পাওয়া, অনেক অনেক মেঘ,
রঙের বিষাদ, এই সব নিয়েই তো জীবন।’
(আমার
কবিতা জীবন)
জীবন নিসঙ্গতার অভিব্যক্তি,
নিঃস্বতার অনুভূতি। আর এই ভয়, এই অসহায়ের ক্ষণ, এই বিষাদ এক একটি ‘না’ এর বিভিন্ন রূপ,
বিভিন্ন রঙ। জ্বালানি কাঠ পুড়তে পুড়েতে ছাই হয়, জীবন পুড়তে পুড়তে হয় নিঃস্বতায় পরিপূর্ণ।
অনেকগুলো না হওয়ার পর
একদিন হওয়া হল
এক তাড়াতাড়ি স্কুলবাড়ি এসে গেছে।
জবাফুলগুলোর রঙ এত লাল
পাখিদের ওড়াওড়ি এই রকম সবুজ।
আনন্দধারা যখন উপহার আনে
অঞ্জলি ভরে উপহার আনে।
(শোনো
জবাফুল)
‘জ্বালানি কাঠ, জ্বলো’তে লিখছেন,
‘… ১৯৫৪’র শেষ দিকে আমি
‘আলোকিত সমন্বয়’ রচনা করলুম।… আমি তখন একটা ঘোরের
মধ্যে আছি। তবু বুঝতে পারলুম এই পটভূমির উপর দু’পা রেখে নিজেকে চতুর্দিকে আকীর্ণ হতে হবে।
বারবার পরিবর্তনের আঁকাবাঁকা পথ, রোমাঞ্চ বিস্ময়, তবু তারই ভিতরে এটাই আমার স্থির কেন্দ্র।’
আলোক সরকার তাঁর প্রথম বই
‘উতলনির্জন’কে সময় দিলেন ১৯৫০
খ্রিস্টাব্দ। যা পাঁচের দশকের প্রথম বই। পরের বছরই ‘শতভিষা’ (১৯৫১) পঞ্চাশের
কবিদের অন্যতম মুখপত্র হিসেবে বেরুলো। সম্পাদনা করলেন আলোক সরকার আর দীপঙ্কর দাশগুপ্ত।
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত আর তরুণ মিত্রও ছিলেন ওতপ্রোতভাবে বিজড়িত। ঘোষিত হল ‘আমরা কবিতাকে
আবার কবিতার কাছে নিয়ে যাব।’
‘কৃত্তিবাস’ (১৯৫৩) প্রকাশ পেতে
তখনো দুবছর বাকি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আনন্দ বাগচি আর দীপঙ্কর মজুমদার প্রস্তুতি নিচ্ছেন
স্বীকারোক্তিমূলক কবিতার অঙ্গীকারে। যেহেতু, পঞ্চাশের অব্যবহিত আগে বাংলা কবিতার মৌল
লিরিক্যাল স্বর কিছুটা হলেও ব্যাহত হয়েছিল; একদিকে ‘যৌনতার কবিতা চাই’ অন্যদিকে ‘জনগনের
কবিতা লেখো’- এই দুই পরস্পরবিরোধী
স্লোগানে বাংলা কবিতার শুদ্ধ স্বর হারিয়ে যেতে বসেছিল, সেহেতু, মানে অরুণকুমার সরকারকে
লিখতে হয়েছিল,
‘সভা মিছিল এবং শায়া
কামিজের পিছনে ছোটাছুটি করাটাই সকল যুগের সব কবির স্বধর্ম হতে পারে না।’
(বাংলা
কবিতার একটি নতুন ধারা)
অনুজ কবি সুবোধ সরকারকেও তাই
আলোক সরকারকে বলতে হলো,
‘বিশুদ্ধ কবিতা হচ্ছে
সেই কবিতা যা কোনো বিষয়ের সঙ্গে জড়িত নয়। ধরো বন্যায় অনেক লোক মারা গেছে, আমার মন খুব
খারাপ, সেটাকে বিষয় করা তো খবরের কাগজের কাজ, বিশুদ্ধ কবিতা হচ্ছে এই মনখারাপটিকে সবকিছু
বাদ দিয়ে প্রকাশ করা।’
তা’বলে Baudelaire এর
মতো সোনায় মোড়া প্যারিস চাননি। যা তাঁর না তা নেবেন কেন? (‘তা আমি নেবোবা কেন যা আমার
নয়?’) ‘দুইপাশে সবুজ ঘাসের স্বাভাবিক। কোনো পদচিহ্ন নেই’ (‘স্বাভাবিক’), ‘বিপক্ষে ঈশ্বর’ তবু চলে যেতে পারেন,
‘কল্পনার স্বরচিত নিশীথ যাত্রা প্রান্তরে’-এ।
“জ্বলে ওঠে রোমাঞ্চিত
নদী
বিচ্ছিন্ন দুঃখের তবু বিস্তৃত গতির--এইটুকুই আমার সম্মান।”
আলোক সরকার তাঁর জীবন বলতে
কবিতাকে বোঝেন। কবিতা নাকি আত্মজীবনী লেখার একটি খসড়া। অর্থাৎ জীবন, জীবনের মতো এক
কঠোর কঠিন প্রতিষ্ঠানকেও তিনি প্রতিহত করেছেন বারবার, কবিতায়, কবিতায় নিহিত দর্শনে।
উনিশশো পঞ্চাশ সাল৷ কবির বয়স
তখন আঠারো। কবিতার আদর্শ নিয়ে লিখতে ঢের বাকি, মানে, ‘কবিতার প্রসঙ্গে আমার কোনো আদর্শই
নেই, অথবা আদর্শহীনতাই আমার কাব্য-আদর্শ’ এই বিশ্বাসে যেতে ‘আমার কবিতা জীবন’ অবধি অপেক্ষা করতে
হতো। ‘উতলনির্জন’ তাঁর হাতে। এই আবেগী একাকীত্বে কবি সুধীন্দ্রনাথ বা অমিয় চক্রবর্তীর মতো
বিপরীত মেরুপ্রান্তবাসী দুই মহীরুহকে দ্বিধাহীন একাগ্রতায় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করলেন,
তার সঙ্গে যুক্ত করলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়ের যুক্তিনিষ্ঠ বস্তুবাদী দর্শন ও রাবীন্দ্রিক
অধ্যাত্মবোধ। তবু মনে হল--
‘নিজস্ব কাব্যভাষা
কাব্য আঙ্গিক যতদিন না অর্জন করতে পারছি, যতদিন না প্রতিষ্ঠিত হচ্ছি স্থিত মানসতায়,
ততদিন কবিতা রচনা না করাই ভালো।’
তারপর, দেড় বছর অপেক্ষা করালেন।
‘নেতি’ আর ‘নাস্তি’কে এড়িয়ে আশ্রয় নিলেন
দক্ষিণারঞ্জনের চিত্রকল্পে। চলার পথের প্রতিটি দৃশ্য, গাছ, পাতায় পাখিতে খুঁজে পেলেন
শাশ্বত সৌন্দর্য। যদিও সে খোঁজার অন্তিম নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত। তবুও, কোনো এক ইঙ্গিত তাঁকে
দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে--
“তুমি যুবক হবে কবে কিশোর কবি!
সময় দেখো সরল ডানায় উড়ে
কাছে যারা ছিল তাদের শান্ত ইতিকথায়
রেখেছে। আজ একলা অজানা দেশ।
তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত নিয়মে, তারা অপর মালা গলায়।
তুমি একা, চেনাছবির ভালোবাসায় দূরে
কাকে রাখো! যেন রাখো৷ কালো মেঘের একাগ্র নির্দেশ
অসীম তিরস্কারে৷ তুমি যুবক হবে কবে কিশোর কবি!”
(কিশোর কবি,
আলোকিত সমন্বয়)
আবার লক্ষ্য করার মতো, ‘আলোকিত সমন্বয়ে লিখছেন,
“একটি গোপন চিরকিশোর
অনিদ্রিত ফুলে
আমার ঈপ্সিতার মুখ তাকে কি আমি জানাবো?
তোমার জলে তারা আসে নিজেই পাল তোলে
আমার জল তাদের সমরাগে
না যদি হয় তারা আমায় ভোলে।”
আলোক সরকার এযুগের কবি। তাই
দেখি বিরুদ্ধাচারণ। আর এ যুগের সন্ততি হওয়ার কারণে, নির্মাণ করে নিতে হয় তাঁর নিজস্ব
ঈশ্বরকে। ফলত ‘শিল্পীর আক্ষেপ’এ তাঁকে লিখতে হয়--
“তোমার ভালোবাসা আমি
গ্রহণ করার অসমর্থ্য
গ্রহণ করি অন্য ম্লান ব্যাখ্যা এনে।”
অমিয় চক্রবর্তী লেখেন--
“চিন্তার সমস্ত রঙ
ধুয়ে গেছে শাদা হয়ে
… … …
বাসনার আলোগুলি ঝিমিয়ে ঝাপসা হয়ে জ্বলে পাশে।”
(এই
বৃষ্টি, পালাবদল)
লিপো লেখেন--
“I sit once and
plumb whole kalpas
see through heaven and earth empty.”
আর আলোক? তিনি লেখেন --
“… আঁধারে আর
কী দেখা যায়?---আঁধার কেবল বাড়ি
আঁধার ফিরে-আসার!
… চিরদিনের চেনা বিরাম
এক দুই তিন আঁধার গুনছি।”
(বাড়ি,
পিতৃনিলয়)
‘মৃত্যুফুল’-এ মৃত্যু চেতনা
আঁধারের মতো হলেও নিরাসক্ত। জন্মান্তরবাদ নেই। ‘ঘর উঠোন’ যাই ভাঙে গড়ে তা
এক জন্মেই।
‘আমার কবিতা জীবন’-এ লিখছেন,
“বিবিধ অভিজ্ঞতা কবিতায়
একত্র করি, কখনো একত্র হয়৷ সেই উজ্জ্বল সমাহার, সেই আয়োজন যে সোনালী সুতোকে প্রয়োজনে
চায়, সেই সুতোর বিচিত্র কারুকাজ, সেখানে কখনো অলৌকিক হীরা, কখনো রহস্যসুদূর তারার নিবিষ্টতা।”
অতএব, ক্লাসিক্যালের সঙ্গে কন্টেম্পরারির, ওরিয়েন্টলের সঙ্গে ওয়েস্টার্ন-এর
এই মেলবন্ধ আলোকের যে একটি নিজস্ব দান তা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। বিশেষত, রিল্কের
‘Duino Elegies’, বা গ্যেটের ‘the elf king’ অথবা ‘নেই’, ‘অভিযাত্রা’, ‘ঈশ্বর’, ‘নিস্তব্ধ’, ‘সহজপাঠ’ বা ‘চোখ’ -এর মতো কবিতায়
ব্লেকের উপস্থিতি।
‘অন্ধকারের উৎসব’ কবিতাগ্রন্থে আমরা
প্রথম লক্ষ্য করি তাঁর শব্দ-বন্ধ সৃষ্টির প্রবণতা। ঠিক কমলকুমারীয় নয়, চলিত শব্দ। তবুও
কমলকুমারের একটা ছাঁচ আছে। ভাব প্রকাশের জন্য ভাষাকে ব্যবহার না করে ভাষার প্রয়োজনে
ভাবকে এঁটে দেওয়া ‘সুহাসিনীর পমেটম’ এ যেমন দেখি, তেমনি দেখি আলোকে।--
১। “ওদিকে হাওয়ার জানালা অভিমানী।
ফিরে গিয়ে
নিবিড় হারাবো।
(হাওয়ার
জানালা)
২। “তুমি নিজে ছুটে আসো, আমার
আশ্চর্য তুমি
আগে কাছে এলে।”
(সচ্ছল
সোপান)
ছন্দ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে
গিয়ে বলেছেন, “ছন্দ শব্দের প্রকৃত তাৎপর্য ছন্দহীনতা।” অর্থাৎ ছন্দের বাইরে
গিয়ে ছন্দের বাঁধন। ছান্দসিক দীপঙ্কর দাশগুপ্ত তাঁর ‘ছড়ার ছন্দ’ প্রবন্ধে লিখছেন--
“ইদানীং কবিদের মধ্যে
আলোক সরকার, আমার বিবেচনায় ছড়ার ছন্দের ব্যবহারে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। পর্বের
বিচিত্র সংস্থান করে, মধ্যখানে অতিপর্ব, পঙক্তির মধ্যে অপূর্ণ পর্ব ইত্যাদি নানা কৌশলে
ব্যবহার করে, এবং ভাবযতি বা অর্ধযতিকে পর্বযতির আনুগত্য থেকে বিযুক্ত করে শুধু পয়ার
নয়, গদ্যের সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন ছড়ার ছন্দে।”
অক্ষরবৃত্তের চেনা আদলও কিছুটা বদলে নিয়ে ১০/৪/৬ পর্ব ভাগ করে লিখেছেন--
“যে পাখিটা উড়ে গেল
| ওকে আমি | পাখি বলে চিনি।”
কবিতায় পায়চারি থামিয়ে যদি
এবার কৃতিতে আসি, তাহলে দেখবো শ্রেষ্ঠ কবিতা (দে’জ) পুরস্কার পাচ্ছে ২০০৬ সালে। জীবনের উপান্তে
সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার আসছে ‘শোনো জবাফুল’-এর সূত্রে। মূলত ‘শতভিষা’কে লিটল ম্যাগাজিনের
সূচণায় টেনে আজীবন অগণন লিটল ম্যাগাজিন এবং ছোট ছোট প্রকাশনার আশ্রয় ছিলেন।
সব শেষে উপসংহার টানলে বলতে হয়, ‘তাঁর কাছে যে কোনো নির্মিত সত্যই আরো রহস্যময়’। আলোক তাঁর কাব্য-পৃথিবীতে এই রহস্যময় নির্মিত সত্যের রূপায়ণ ঘটিয়েছেন। বাংলা কবিতা পাঠের অভ্যাসে যা প্রথম, অপরিচিত। তথাকথিত আধুনিকতার অমঙ্গলদীর্ণতা থেকে তাঁর কন্ঠস্বর বহুদূরে ব্যক্তিগত অনুভূতিমালায় সঞ্চারণশীল৷ দৈনন্দিন যুদ্ধ সেখানে নেই। যদিও ‘আশ্রয়ের বহির্গৃহ’তে লেখেন, “যা কিছু অ
∾♦️∾♦️∾
বাঙালির পয়লা বৈশাখ আর হালখাতা সমার্থক।“খেরোর খাতা” কতটা লীলা মজুমদারের
আর কতটা বাঙালির তা আলাদা করা মুশকিল।
বাঙালি নববর্ষে হালখাতার প্রচলন সেই আঠারো শতকের সময় থেকে।বৈঠকখানা বাজারে
এই লাল শালু দিয়ে বাঁধানো হালখাতা বা খেরোর খাতা প্রধানত তৈরী হয়।খেরো বস্তুটি আসলে
লাল রঙের খসখসে সুতির উপাদান বইপত্র এর মলাটের কাজে ব্যবহৃত হত।এই গোটানো বা ভাঁজ করা
বইগুলো হাতে বানিয়ে পরে সেটাকে সাদা সুতো দিয়ে
সেলাই করা হত।
ইতিহাসঃ
এই খেরোর খাতার প্রচলন আসলে সেই ইংরেজদের আমলে তখন অবশ্য নবাব-রা ছিলেন।আগে এই খেরোর খাতা বানাতেন মূলত পুর্ব
বঙ্গিয়রা।তবে এখন এই কারিগরেরা মূলত জয়নগর ও পাণ্ডয়ার বাসিন্দা।
এই খেরোর খাতা কিন্তু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তাও বহন করে।কেননা বাংলা
নববর্ষে বহুল প্রচলিত এই খেরোর খাতার মূল কারিগর কিন্তু মুসলিমরাই।
ঐতিহাসিকদের মতে,মোঘল প্রধান নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে “পুন্যসহ” বলে একটি উৎসব পালন
করতেন।সেটি ছিল আসলে মুর্শিদাবাদ ও তার আশেপাশের সমস্ত অনার অধীনস্থ জমিদারদের বকেয়া
খাজনা মেটাবার দিন।আবার ওই দিনেই নতুন করে পরের বছরের জন্য অ্যাকাউন্ট খোলা হত।বসন্তের
ফসল ওঠার সময় এই উৎসব হত।সেখানে প্রথা অনুযায়ী উপহার বা সওগাত বিনিময় হত।আকবরের
“Economic policy” র সাথে সাযুজ্য রেখে এই তারিখটিও বাংলা নববর্ষের সাথে আশ্চর্য্য সমাপতন ।আবার একটু খেয়াল করলে আমরা দেখব পয়লা বৈশাখ
আর্থিক নতুন বছরের সুচনাকেও চিহ্নিত করে।
খেরো বস্তুটি জোগাড় করাটা খুব সহজ নয়।এখন মূলত ঝাঁসি থেকেই আসে।কিন্তু বাংলায়
বর্তমানে এর চাহিদা এত কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা ঠিক করেছেন তারা ক্যানভাসের
উপাদান ব্যবহার করবেন।কিন্তু এই খেরো শালু বা ক্যানভাসের চেয়ে অনেক বেশি টেঁকসই ও কিছুটা
দামীও বটে।কারণ এটি জলনিরোধকধর্মীতা।
এবার কি করে এটি তৈরী হয় তার গল্পটা একটু বলে রাখি।এই খেরো আসলে লাল শর্করা
বা স্টার্চ জাতীয় এক উপাদান।এটি প্রথমে সাইজ মত কাটা হয়।তারপর আঠা দিয়ে পাতলা কাগজের
ফিল্মের সাথে জোড়া হয় ও তারপর রোদে শোকানো
হয়।আগে অবশ্য অনেকদিন আগে থেকেই কভার তৈরী করা হত তারপর শোকানো হত যাতে শুধু বড় শিটগুলো
কাটা আর সেলাই করার কাজটূকুই বাকি থাকে।
সবথেকে ঝামেলার কাজ হল,মেশিনে কাটা হয়ে আসা এই Fine Sheet গুলো হাতে গুনে
৩৭২ পাতা জড় করতে হয়।কারণ ১দিস্তা মানে ৩৭২ পাতা।তারপর এই ৩৭২ পাতা সেলাই করে একটা
বই বা হালখাতা তৈরী হয়।
বর্তমান চালচিত্রঃ
এক দিস্তা কাগজের খরচ পড়ে ৮০ তাকা।আর সেটি বিক্রি হয় ৯০ বা ১০০ তাকায়।যারা
বানান তারা মোটামুটি ১৬০০০ থেকে ২২০০০ টাকা পান সব বই বানিয়ে।যারা উপাদানের জন্য টাকা
দেন তারা ঠিকমতই ফেরত পান।কিন্তু যারা বানাচ্ছেন
যারা কর্মী তার যত সংখ্যার খাতা বানান না কেন তাদের উপার্জন কিন্তু একই থাকে।অথচ
তাদের দিনের পর দিন খাতা বানানোর সময় কারখানায় থেকে কাজ করে যেতে হয়।আগে খেরোর খাতা
বা হালখাতা বানানোর জন্য কারিগরেরা প্রায় ৬ মাস আগে থেকে তোড়জোড় শুরু করতেন।কিন্তু
আস্তে আস্তে খেরোর খাতার চাহিদা কমায় মাত্র এক দেড় মাস আগে থেকে কাজ শুরু করলেই কাজ
মিটে যায়।একটা পরিসংখ্যান দিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে।আগে নববর্ষের আগের মাসে ২০,০০০
খাতা বানাতেন ওনারা কিন্তু এখন সেই সংখ্যাটা ৩,৫০০ এ এসে দাঁড়িয়েছে।এখন দোকানদার বা
ব্যবসায়ীরা হার্ডবাউন্ড খাতা বা ডিজিটাল স্প্রেডশিট এর দিকে ঝুঁকছেন।
বে-হালখাতাঃ
গত বছর লকডাউনের জন্য বইপাড়ায় বা
কোনও জায়গাতেই খেরোর খাতা তেমন বিক্রি হয়নি।সেই সময় পূর্ণমাত্রায় লকডাউন ছিল।আস্তে
আস্তে ডিজিটাল স্প্রেডশিট বা হার্ডবাউন্ড খাতার রমরমা বেড়ে যাওয়ায় এই হালখাতা প্রায়
অবলুপ্তপ্রায়।হয়ত আরো কয়েক বছর পরে এই প্রথাটাই আর থাকবে না।কারিগরেরাও অন্য পেশা বেছে
নেবেন।বড় স্মতিহীন এই সময়,সমাজ।এই ডিজিটালে টাল
সামলানো দায়। আরো কিছু বছর পরে দু একটা মুখচোরা হালখাতা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে
বাঙালি সংস্কৃতির ফাঁকা “জলসাঘর” এর দিকে।বিলয়বিন্দুর
দিকে চলে গেলে শয়নযান আরো ক্ষয়ে যাবে আমাদের
গতজন্মের মেমোরি কার্ড।এরপরও কি আমরা হালখাতার হালহকিকত একবারও জানতে চাইবো না?
No comments:
Post a Comment